Tuesday, April 16, 2024

কর্নেল এবং… – শেষাংশ

কর্নেল এবং… – শেষাংশ

২১

ছেঁড়া পাতা এবং ‘তারা’

     ‘কি সম্পর্ক জানি না, তবে ১৯৯৭ সালের এই ঘটনার ঠিক এক মাস পরেই হার্লানের সঙ্গে ইনোভিটার যোগাযোগ হয় ইমেল মারফত। তারও মাস কয়েক পরে ডি আর আই-এর অফিসে চুরি হয়। কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ স্যাম্পেল নিয়ে চোর পালায়। প্রতিষ্ঠান নিজেদের সুনাম বজায় রাখতে চুরি যাওয়া জিনিসপত্রের লিস্ট কোথাও প্রকাশ করেনি। তাই জানা সম্ভব নয় যে ঠিক কি কি সেখান থেকে চুরি যায়। এর কয়েক মাস পরেই ঘর থেকে বেরিয়ে প্রাতঃভ্রমণ করতে গিয়ে হার্লান উধাও হয়। আর সেই হার্লান তারও কয়েক বছর পরে ফিরে আসেন তোমার দূরবীনে এই মাল্টার মাটিতে। সত্যি কি কাকতালীয় ঘটনা বলে মনে হয় আনা?’ কর্নেল হাসেন।

     আনা কঠিন দৃষ্টি নিয়ে বিজ্ঞানীর দিকে তাকায়।

     চোখ বন্ধ করে আত্মগতভাবে বিজ্ঞানী বলেন, ‘ভালো কাজ করতে খারাপ লোকেদের ব্যবহার করতে হয়, এটাই ইনোভিটার মন্ত্র। তাই যখন ওরা আমাকে মাল্টায় আবিষ্কৃত মৃত প্রাণীটার ছবি দেখিয়ে আমার সাহায্য চায়, তখন ওদের সঙ্গে গোপনে দেখা করে অন্তর্ধানের পরিকল্পনা আঁটি আমরা। ইমেলে ওদের গালাগাল করে ওদের লোকেদের দিয়েই সংস্থা থেকে বেশ কয়েকটা নিতান্ত মামুলি নিদর্শনের সঙ্গে জোগাড় করে নিই আমাদের সবথেকে দামি আবিষ্কার, প্রাগৈতিহাসিক স্পাইনোসোরাসের ডিএনএ। হল্যান্ডের একটা কয়লাখনি থেকে উদ্ধার পাওয়া ফসিলের হাড়ের মধ্যে থাকা মজ্জা থেকে সংগৃহিত এবং সংরক্ষিত লুপ্ত ডাইনোসরের প্রাণভোমরা। এই ফাঁকে বলে রাখি স্পাইনোসোরাস হল মাটির উপরে চলে ফিরে বেড়ানো সেই অতিকায় চারপেয়ে রাক্ষস যা কিনা টি-রেক্সদের মেরে ফেলতো নির্দ্বিধায়।’

     ‘এতে লাভ?’ আনা অধৈর্য। আমরাও।

     ‘..আসলে…ইনোভিটা আমাকে জানিয়েছিল, মাল্টায় পাওয়া প্রাণীটা আসলে নাকি লক্ষ বছর আগে সমুদ্রের বুকে ঘুরে বেড়ানো সব থেকে ভয়ানক উভচর প্রাণী মোজেসর। যাদের গঠন প্রকৃতি অনেকটাই অতিকায় কুমিরের মতো। সব থেকে আশ্চর্য ব্যাপার কি জানো আনা? মৃতদেহটা লক্ষ বছর ধরে দক্ষিণ মেরুতে বরফের মধ্যে অবিকৃত অবস্থায় জমে ছিল। মানুষের বোকামিতে যখন পৃথিবী জুড়ে উষ্ণতা বাড়ছে তখন সেই বরফ গলে সমুদ্রের ঢেউয়ে এসে সে পৌঁছায় মাল্টায়। তার থেকেও বিচিত্র ঘটনাটা কি জানো আনা?’ ভদ্রলোক এবার চেয়ারে সোজা হয়ে বসেছেন, চোখদুটো খোলা এবং নিবদ্ধ আনার দিকে।

     আনা নির্বাক।

     বিজ্ঞানী বলেন ভাবলেশহীন মুখে, ‘মৃত প্রাণীটাকে যখন উদ্ধার করা হয় সে তখন গর্ভবতী। ভাবতে পারছো?’

     আমরা শিউরে উঠি।

     ‘ভাবতে পারছো? সময় কিংবা প্রতিকূল পরিবেশও কেড়ে নিতে পারেনি তার পেটে বাড়তে থাকা ডিমগুলোকে। যদিও হিমবাহের ঠান্ডায় শুধু তারা ঘুমিয়ে ছিল চিরকালের জন্য।’ বিজ্ঞানীর বিষণ্ণ মুখে কি একটুকরো হাসি দেখা গেল?

     ‘তাই ইনোভিটার সাহায্যে, তুমি মাল্টার মাটিতে লুকোনো গবেষণাগার বানিয়ে বসলে অবশেষে। ডিমগুলো থেকে বাচ্চা মোজেসোরাস ফুটিয়ে তোলার দায়িত্ব নিলে সবার অগোচরে -’ কর্নেল বাকিটা শেষ করেন।

     মাথা নাড়েন বিজ্ঞানী, ‘সে তো ওরাও পারতো, হয়তো। আমি ধরলাম অন্যপথ। আমি ভাবলাম, যদি কোনওভাবে পৃথিবীর সব থেকে ভয়ানক আর সবথেকে বড় ডাইনোসরদের মধ্যে একটা যোগাযোগ তৈরী করতে পারি, তাহলে কেমন হয়? তাই স্পাইনোসোরাসের ডিএনএ প্রতিস্থাপন করা হল মেজোসোরাসের ডিমে। জটিল খরচ সাপেক্ষ ব্যাপার, কিন্তু ইনোভিটা অর্থ খরচে কার্পণ্য করেনি। এই যে গোপন ল্যাবেরটরি দেখছো, এখানে একসময় জানা পঞ্চাশেক বিজ্ঞানী আমার সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এই মহাযজ্ঞে মেতে উঠেছিল। তারপর… তারপর একদিন সেই দিনটা এলো,  যেদিন ডিম ফুটে বেরোল একটা ছোট্ট নিরীহ প্রাণী…’ হার্লান যেন আবার ফিরে গেছেন নিজের সঙ্গে কথোপকথনে।

     ‘মায়ের গুণে ছেলে পেয়েছে লম্বা হবার প্রবণতা আর এদিকে বাবার গুণে তার জুটেছে জল আর স্থলে ঘুরে বেড়াবার শক্তি। দুটো প্রাণীরই চামড়ায় মেলানিনের প্রাধান্য থাকায় সন্তান পেয়েছে পিঠে রং বেরঙের শক্ত খোলস। আর বিবর্তনের আশ্চর্য লুকোনো বংশধারায় তার জুটেছে দুর্বল একজোড়া পাখা। সবার চোখের আড়ালে সে বড় হয়ে উঠলো এই খানেই, আমাদের চোখের সামনে। এদিকে, ইনোভিটা চাপ দিতে শুরু করেছিল আমাকে, ওদের এবার ব্যবসার লাভ চাই।’  বিজ্ঞানী ব্যথিত চোখে তাকান আমাদের দিকে।

     ‘লাভ? কিসের লাভ-’ আনার প্রশ্ন।

     ‘আসলে, আমি ওদের লোভ দেখিয়েছিলাম। ওদের একটা অর্বাচীন স্বপ্ন দেখিয়েছিলাম। বলেছিলাম এরকম জেনেটিক পরীক্ষা চিকিৎসা বিজ্ঞানে খুব উপযোগী হতে পারে। ওদের বিজ্ঞানীরাও সহমত ছিল। তাই একটা মনগড়া তত্ত্ব খাড়া করে ওদের জানিয়েছিলাম যে, এই অতিকায় প্রাণীগুলোর চামড়ায় আছে ক্ষত নিরাময় গুণাবলী। ওদের হরমোনে মিলতে পারে দুরারোগ্য রোগ সারাবার ক্ষমতা। আমি নিরুপায়, বাচ্চাটা তখন বড় হচ্ছে একটু একটু করে। ওর ক্ষিদে মারাত্মক, প্রতিনিয়ত ওর রক্ষণাবেক্ষণে প্রয়োজন অর্থের। ইনোভিটা অধৈর্য হয়ে পড়লো একদিন, তারপর গবেষণাগার গুটিয়ে নেবার হুমকি দিলো আমায়। আমি আশ্বাস দিলাম, ভরসা যোগালাম, অনেক মিথ্যে কথা বললাম -’ হার্লানের গলাটা এবার ক্লান্ত শোনায়।

     ‘ইনোভিটা গবেষণা গুটিয়ে নিলো একসময়। কারণ মিথ্যে কথা কোনওদিন সত্যি হয় না, তাই তো?’ কর্নেলের গলায় শ্লেষের ছোঁয়া।

     ‘না কর্নেল, মিথ্যে সত্যি হয়। কিন্তু সেই সত্যিকে লোভীদের চোখ থেকে লুকিয়ে রাখতে হয়।’ বিজ্ঞানী বলে ওঠেন।

     আমরা নির্বাক শ্রোতা, এমনকি কর্নেলও। আমাদের মুখগুলোর দিকে করুণাভেজা চোখদুটো আলতো করে বুলিয়ে হার্লান বলেন, ‘হ্যাঁ, ওদের হরমোনে পাওয়া গেল এক অন্যরকমের সঞ্জীবনী সুধা। জরা আর বার্ধক্যকে ঠেকিয়ে রাখার মহামূল্য উপাদান- আমি যার নাম দিয়েছি ‘নেভার উইন্টার’। এর নিয়মিত ব্যবহারে শরীর থাকবে সক্ষম এবং সুস্থ। রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা হবে অকল্পনীয়…’

     ‘গাঁজাখুরি গল্প ফেঁদে আমাদের বোকা বানাতে চাইছ হার্লান? কিন্তু তাতে তোমার কি লাভ?’ কর্নেল ধমকে ওঠেন।

     ‘আমাকে তো একসময় ‘টোনি’ বলেই ডাকতেন কর্নেল? আজ কি তবে আপনার বন্ধু হবার যোগ্য নই আমি?’ হার্লান বলেন, কিন্তু মুখে একটুও ভাবান্তর দেখতে পেলাম না আমি।

     ‘সত্যি কথা বললে নিশ্চয় তোমাকে বন্ধু বলে স্বীকার করতে পারি, কিন্তু-’ কর্নেলকে থামিয়ে বিজ্ঞানী বলেন, ‘কিন্তু কী কর্নেল? আমার দোষ আমি এই অন্ধকার সুড়ঙ্গে বসে পৃথিবী বদলে দেওয়া একটা অত্যাশ্চর্য আবিষ্কার করেছি? এটাই আমার অপরাধ?’ রাগ নেই, হতাশা নেই, শুধু বিষন্নতা মানুষটার গলায়, সঙ্গে সামান্য অভিমান?

     ‘আমি সত্য জানতে চাই-’ কর্নেলের সুর নরম হয় না।

     ‘সত্য আপনার সামনে বসে আছে কর্নেল,’ হার্লান বলে চলেন, ‘আমাকে দেখে কত বছর বয়েস হয়েছে বলে মনে হয় আপনার বা আপনাদের?’

     ‘বড়জোর চল্লিশ?’ হালদারমশাইয়ের গলা শুনে আমরা চমকে উঠি আর ভাবি ভদ্রলোক ভুল কিছুই তো বলেননি।

     ‘আনা, তোমার কি মনে হয়?’ বিজ্ঞানী যেন কৌতূহলী ছাত্রদের নিয়ে মজার খেলা খেলছেন।

     ‘তোমাকে প্রথমবার যেরকম দেখেছি ঠিক সেরকমই আছ-’ আনা কাঁধ ঝাঁকায়।

     ‘বাপ মায়ের জিনগত চরিত্র বোধহয়-’ কর্নেল টিপ্পনি কাটেন।

     ‘না, ‘নেভার উইন্টার’ উপাদানের কৃপা কর্নেল। নিজের শরীরে নিয়েছি ওর হরমোনের নির্যাস। আর সেই থেকে বয়েসের সংখ্যাটা আটকে গেছে হঠাৎ করে। অমর হতে পারবো কিনা সেটা একমাত্র সময় বলতে পারবে যদিও-’ হার্লান একটা ভয়ানক সম্ভাবনা আমাদের দিকে ছুঁড়ে দেন। তারপর হালদার মশাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলেন বিজ্ঞানী, ‘আমার বয়েস এখন বাষট্টি-’।

     ‘তা এই আবিষ্কার বিক্রি করে তো কোটিপতি হতে পারতে, তার বদলে ইনোভিটাকে মিথ্যে বলে কি লাভ হল?’ কর্নেল প্রশ্ন করেন।

     ‘লাভ হল একাকিত্ব, নিজের আবিষ্কারের ওপর সম্পূর্ণ কতৃত্ব। ওরা সব গবেষণা বন্ধ করে দিলেও আমার এবং আমার সন্তানকে এখানে ফেলে রেখে গেছে কয়েকজন পাহারাদারদের দায়িত্বে। ওরাই আমাদের প্রহরী এবং অভিভাবক।’

     ‘তারা এখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন-’ এতক্ষণ পরে এলাইনের গলা শুনতে পেলাম।

     ‘এক তৃতীয়াংশ,’ হারলানের মুখে অভিব্যক্তিহীন কাঠিন্য, ‘বাকিরা শুধু একটা বোতাম চাপার অপেক্ষায়-’

     ‘তোমার এই সন্তান, বিশালাকৃতি প্রাণী, এটা কোথায় এখন?’ কর্নেল ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞাসা করেন।

     ‘খবরের কাগজ যাকে ‘সমুদ্র দানব’ বলে ডাকে?’ হার্লান কোটের ভিতর পকেট থেকে একটা ভাঁজ করা দৈনিক বার করে তাতে চোখ রাখেন, ‘ওদের চিন্তার অগভীরতা আমাকে ভাবায় কর্নেল-’ ভদ্রলোক এবার পকেট থেকে একটা ছোট্ট রিমোট বার করে তাতে চাপ দেন।

     ঘরের ডানদিকের বিশাল দেয়ালজুড়ে আলোর উদ্ভাস দেখে আমরা চমকে উঠি। আমাদের সবার দৃষ্টি তখন কাচের দেওয়ালের ওধারে আলোয় ভেসে যাওয়া পরিষ্কার নীল জলের মধ্যে নিমজ্জিত।

     ‘ওটা দেওয়াল নয়,’ হালদার মশাই কাঁপতে থাকেন, ‘ওটা আসলে অ্যাকোয়ারিয়াম-’

 

২২

সন্তান

     ‘একদম ঠিক,’ হার্লান যেন আমাদের নিয়ে মস্করা করছেন, ‘তবে ওটা প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার লম্বা একটা টানেল-’

     আমি কাঁপছি। আমাদের সবাই পিছিয়ে এসেছি। উল্টোদিকের দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে তাকিয়ে আছি সামনের কাঁচের দেওয়ালের ওধারে জল কেটে ঘুরে বেড়ানো বিকৃত জন্তুটার দিকে।

     ‘ওর নাম নসিনাস,’ হার্লান আত্মগতভাবে ঘোষণা করেন, ‘ও আমার সন্তান। অসাধারণ, তাই না?’

     আমার চোখদুটো সামনের দেওয়ালে যেন চুম্বকের আকর্ষণে আটকে গেছে। জন্তুটা হঠাৎ গোৎ খেয়ে নেমে আসছে আমাদের দিকে। তার চেহারাটা ক্রমে যেন ছোট থেকে বড় হচ্ছে আমাদেরই বিস্ফারিত চোখের সামনে। পিছনের দুটো লম্বা সবল পায়ের পাতায় ধাক্কা দিয়ে সে নেমে এলো কাচের ঘরের মেঝেতে, দেওয়ালের ওপার থেকে চোখ রাখলো আমাদের দিকে। সেই একই লম্বা ধারালো ঠোঁট, সেই একই সবুজ চোখের চাহনি, সেই এক ডানার গঠন। আমাদের চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক প্রাগৌতিহাসিক প্রাণী। সময়ের ধুলোঝড় উপেক্ষা করে সে এসে দাঁড়িয়েছে আমাদের মুখোমুখি। তাকিয়ে আছে আমাদেরই দিকে। শরীর জুড়ে শিহরণ জাগছে আমার।  বাকিদের অবস্থা বর্ণনা করার শক্তি আমার নেই।

     কর্নেল আমাদের ছেড়ে এগিয়ে যান। মাথা থেকে আর্মি ক্যাপটা খুলে প্রাণীটার চোখে চোখ রাখেন, সেও তাকিয়ে আছে কৌতূহলী দৃষ্টি মেলে।

     ‘কর্নেল, বিপদ হতে পারে-’ আমি বাধা দিতে চাই, আনা আমার হাত চেপে ধরে।

     ‘অবাস্তব, অত্যাশ্চর্য আবিষ্কার হার্লান। তোমার সন্তান সত্যিই আমাকে মুগ্ধ করেছে-’ কর্নেল বিড়বিড় করেন, ‘কিন্তু প্রাণীটার দৈর্ঘ হতে পারে সর্বসাকুল্যে পঞ্চাশ ফিট, হেলিকপ্টারে থেকে যে ছবি তুলেছিল সে জানিয়েছে প্রাণীটার দৈর্ঘ ছিল প্রায় আশি ফুট। অবশ্য গল্পকাহিনী সবসময়-’

     আরেকটা খুট করে শব্দ। কর্নেল ঘুরে দাঁড়ান আমাদের দিকে। এ কি? কর্নেলের চোখদুটো এরকম ভাষাহীন কেন? আমরা বুঝতে পারি কর্নেলের চোখ নিবদ্ধ আমাদের পিছনদিকের দেওয়ালে। আমরা ঘুরে দাঁড়াই।

     আমাদের পিছনের অন্ধকার দেওয়ালটাও এখন আলোর ঝর্ণাধারায় স্নাত। তার ওপাশে বহুদূরে ঘুরে বেড়াচ্ছে আরেকটা প্রাণী। হুবহু আগেরটার মতো দেখতে। তবে এতদূর থেকেও বোঝা যাচ্ছে, তার দৈর্ঘ প্রস্থ আগেরটার থেকে প্রায় দ্বিগুন।

     ‘আমার দ্বিতীয় সন্তান কর্নেল, নসিথিউস-’ বিজ্ঞানীর স্বর শুনি আমরা, ‘হ্যাঁ, সব কটা ডিম থেকে মাত্র দুটোকেই বাঁচানো গেছিলো। এটা বয়সে সবথেকে বড়, আকারে প্রকারেও-’

     আতঙ্কে আমার পা কাঁপছে। হালদারমশাই চোখের পলক ফেলছেন না। আনা নির্বাক, এলাইনের চোয়াল শক্ত।

     ‘আমি বাকরুদ্ধ হার্লান,’ কর্নেল বলেন, ‘এদের দেখে জীবন সার্থক হল। একটাই দুঃখ যদি এদের স্বর শুনতে পেতাম-’

     ‘সেটাও সম্ভব কর্নেল-’ আরেকটা খুট করে শব্দ, আর আমাদের হাড় হিম করে ভেসে এলো আমার অতিপরিচিত সেই শব্দ, ‘ঘড়…ঘড়…ঘড়…’

     শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ।

     ‘জলের মধ্যে রাখা মাইক্রোফোন থেকে আসছে শব্দটা, তাই না?’ কর্নেল বলেন।

     ‘ঠিক তাই-’ হার্লানের কন্ঠস্বর চাপা পড়ে যায় একটা তীব্র চিৎকারে। আমরা দুহাতে কান চাপা দিই। কাচের দেওয়ালগুলো যেন ভেঙে পড়বে এবার।

     ‘দুঃখিত,’ খুট করে আরেকটা শব্দের পর চিৎকারের শব্দটা হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়, ‘ওরা ক্ষুধার্ত এখন-’ হার্লান গর্বিত বাপের মতো বলে ওঠেন।

     ‘হার্লান, ফিরে চলো আমাদের সঙ্গে।’ কর্নেল মৃদুস্বরে বলেন, ‘তোমার আবিষ্কারের গুণে পৃথিবীর মানুষ তোমাকে দুহাত বাড়িয়ে গ্রহণ করবে, এটুকু আমি আশা করি-’

     ‘মানুষ? মানুষের কথা বলছেন কর্নেল?’ হার্লান যেন বিয়োগান্ত কোনও নাটকের একজন নায়ক, ‘যে মানুষ শুধু নিজেদের স্বার্থে দুনিয়াটাকে আবর্জনার স্তুপ বানিয়ে ফেলেছে সেই মানুষদের কথা বলছেন কর্নেল? আপনি জানেন কর্নেল, যখন ডি আর আই-এ ছিলাম, দল বেঁধে ছুটির দিনে বাচ্চাদের নিয়ে বাপ মায়েরা আসতো আমাদের ক্যাম্পে। ওদের সামনে রাখতাম আমাদের আবিষ্কারগুলো। আমাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে একটু একটু করে খুঁজে পাওয়া হাড়গুলোকে। সেগুলো দেখে কি বলতো জানেন ওরা? ওরা হাসতো কর্নেল। হ্যাঁ, হাসতো। কেউ বলতো কি কুচ্ছিত দেখতে দেখেছিস? কেউ বলতো ভাগ্যিস মারা গেছিলো ওরা। কেউ বা চরম ঔদাসীন্য দেখিয়ে বলতো, ধুস দিনটা মাঠে মারা গেল, সিনেমায় তো দেখিয়েছিল এরা দৈর্ঘে একশো পঁয়ষট্টি ফিট হয়। ওদের অজ্ঞতা, ওদের অবহেলা আমাকে ঘৃণা শব্দটা শিখিয়েছিল। মানুষকে ঘৃণা করতে শুরু করেছিলাম আমি। ওদের সবাইকে চোখে আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে দিতে চেয়েছিলাম, ‘ভয়’ কাকে বলে। প্রাগৈতিহাসিক শক্তির সামনে যদি একদিন মুখোমুখি দাঁড়াই আমরা তাহলে পারবো তো ওদের চোখে চোখ রাখতে? ভয় মানুষকে শেখায় বিনয়। আমি সেই বিনয়টুকুই মানুষকে শেখাতে চেয়েছিলাম কর্নেল -’ আহত বিজ্ঞানী থামেন।

     ‘কিন্তু এর ভবিষ্যৎ?’ কর্নেল হতাশ কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করেন।

     ‘ভবিষ্যৎ নিয়ে আমি ভাবিনি কোনওদিন। তবে কিনা আমার আবিষ্কারকে এগিয়ে নিতে চেয়েছি অর্থপিশাচ সংস্থাগুলোর হাত থেকে বাঁচিয়ে। চেয়েছি ওদের বংশবৃদ্ধি করে আরও নানান পরীক্ষা নিরীক্ষা চালাতে।’

     ‘ওমেগা কর্প সে ব্যাপারে আপনাকে সাহায্য করতে পারে হার্লান-’ আনা মুখ খোলে, মাথা নাড়ে এলাইন।

     ‘আমার যত টাকা দরকার তত টাকা কোন সুস্থ মানুষ কিংবা সংস্থা দিতে পারবে না আনা। ওটার যোগান হতে পারে দেশ বিদেশের অ-মানুষেরা। তাদের জোগাড় করতে সাহায্য করবে ইন্টারনেট। বোঝা গেল?’ আমরা মাথা নাড়াই নেতিবাচকভাবে।

     ‘নেভার উইন্টার বিক্রি করে?’ কর্নেল গম্ভীর স্বরে জানতে চান। হার্লান উত্তর দেন না শুধু মাথা দোলান খুব ধীরে।

     ‘তুমি বিজ্ঞানী নও, তুমি একজন শয়তান!’ আনা চেঁচিয়ে ওঠে।

     ‘শয়তানদের দুনিয়ায় ভগবান সাজার ইচ্ছে আমার কোনওকালেই ছিল না যে-’ লোকটার চোখদুটো যে কতটা শীতল সেটা এবার বুঝতে পারি।

     ‘এখনও সময় আছে হার্লান, আমাদের সঙ্গে আলোর দুনিয়ায় ফিরে চলো-’ কর্নেলের গলাও ইস্পাতকঠিন।

     ‘দুঃখিত, আলোর থেকে অন্ধকারেই আমি স্বচ্ছন্দ-’ ভদ্রলোক অনড়।

     আমরা নির্বাক দর্শক।

২৩

আস্তিনের নিচে

     ‘আমার কাজ শেষ হয়ে এসেছে। তোমাদের সবাইকে পথ দেখিয়ে এই গুহায় টেনে এনেছি, সব সত্যিগুলো জানিয়েছি, সমস্ত পাপের কাহিনী নিজমুখে স্বীকার করেছি। এবার আমি মুক্ত,’ বিজ্ঞানী উঠে দাঁড়ান, বাম হাতের দস্তানা খোলেন, ‘এবার সব প্রমান লোপাট করার সময় এসেছে। এবার একদম পরিষ্কার বিবেক নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। আমি দুঃখিত আনা-’ হার্লান হঠাৎ থমকে যান, কেটে কেটে বলেন আমাদের উদ্দেশ্যে, ‘এবার নাটকের শেষ অঙ্ক এসে উপস্থিত।’

     ‘কোনওরকম বোকামি কোরো না,’ কর্নেল গর্জে ওঠেন, ‘তোমার সব গুন্ডাদের আগ্নেয়াস্ত্র বিকল করে দেওয়া হয়েছে। আমাদের সঙ্গে গায়ের জোরে পারবে না, সে কথা ভুলো না কিন্তু- ‘

     ডান হাতের দস্তানা খুলে হার্লান আমাদের দিকে তাকান। আমি টের পেলাম হালদারমশাই আমার কব্জি চেপে ধরেছেন।

     হার্লানের জামার আস্তিন থেকে বেরিয়ে আছে একটা ধাতব করতল। রুপোলি রঙের মাঝখানে মাঝখানে সোনালী রঙের চমক। বিজ্ঞানী আঙ্গুলগুলো মুঠো করেন। খটাস করে একটা শব্দ শুনতে পাই আমরা সবাই।

     ‘হে ঈশ্বর-’ আনা ডুকরে ওঠে।

     ‘‘বায়োনিক হাত’, আমার স্নায়ুর নির্দেশে চলে এটা, আমি ইনোভিটার কাছে ঋণী এই উপহারটার জন্য,’ লোকটা এলাইনের দিকে তাকায়, ‘তোমার ‘জিরো’ আগ্নেয়াস্ত্রকে বিকল করলেও আমার হাতের ওপর ওর কোনও জারিজুরি খাটবে না। এবার বল তো গায়ের জোরে কে এগিয়ে?’

     ‘ছিঃ, হার্লান, তোমাকে আমি ঘৃণা করি-’ কর্নেল হতাশ গলায় গর্জে উঠলেন।

     ‘দুঃখিত কর্নেল, আসলে ছোট্ট নসিনসকে খাওয়াতে গিয়ে বিপত্তিটা হয়েছিল। ওর একটা ধারালো কামড়ে হাতখানা হারিয়েছিলাম। রক্তক্ষরণে মারা যেতাম হয়তো, কিন্তু ক্ষতের মেরামত করে ওরা আমাকে দিয়েছিল এই হাতটা। খরচ পড়েছিল একশকুড়ি মিলিয়ন ডলার। বলেছিলাম না শয়তানদের অর্থবল ভালো মানুষদের থেকে অনেক বেশি-’ হার্লান এবার নিজের কোটটা খুলে নিজের জামার আস্তিন গোটাচ্ছেন। তার ডান হাতের ভয়ানক ধাতব কঙ্কালটা আলোয় উজ্জ্বল হয়ে উঠছে।

     ‘বলতে ভুলে গেছি,’ লোকটা যেন আমাদের একের পর এক চমক দিয়ে চলেছেন দক্ষ জাদুকরের মতো, ‘প্রায় গোটা তিরিশেক ভাড়াটে গুন্ডা তোমাদের স্বাগত জানাতে এসে উপস্থিত হচ্ছে মিনিট দুয়েকের মধ্যে। যদি ওদের হাত থেকে নিজেদের বাঁচাতে না পারো তাহলে কিন্তু নিমেষে আমার সন্তানদের পেটে চালান হবে তোমার সবাই-’

     কর্নেল জ্বলন্ত চোখে তাকান বিজ্ঞানীর দিকে।

     ধীরেসুস্থে নিচু হন তিনি, মোজার ভিতরে হাত চালান করেন। হার্লান বিষণ্ণ হাসে, ‘কর্নেল, আপনি বোধহয় ভুলে যাচ্ছেন, এলাইনের কল্যানে এখানে বন্দুক কাজ করবে না-’

     কর্নেলের মুখে ফিরে এসেছে সেই সবভাসিদ্ধ হাসিটা। ‘বন্দুক কাজ করবে না, কিন্তু এটা করবে-’ মোজার আড়াল থেকে তিনি যেটা বার করলেন সেটা দেখে আমরা আঁতকে উঠলাম।

     ‘এটার নাম ‘শয়তান’। না, ভারতীয় নয়, রাশিয়ান আর্মির অস্ত্র এটা। আর তোমার যমজ সন্তানের মতো এটাও পাওয়া যায় জোড়ায়।’ বাঁ পায়ের মোজা থেকে বার করলেন আরেকটা অস্ত্র। এখন তাঁর দুহাতে দুটো ভীষণ দর্শন ছুরি।

     ‘কর্নেল, আমি চিরকাল আপনার বাহাদুরির গল্প শুনে এসেছি,’ হার্লান শান্ত ভাবে উঁচু জায়গাটা থেকে নেমে আসেন, ‘আজ সামনা সামনি ক্ষমতার দৌড়টা যাচাই করে নিই একটু-’

     কর্নেল আমাদের দিকে মাথা ঘোরান, ‘তোমরা তৈরী তো?’ আমরা নির্বাক। বুড়ো ঘুঘুর শান্ত স্বরটা বাজছে আকাশবাণীর মতো, ‘ফলাফল যাই হোক না কেন, আমাদের দুজনের লড়াইটা সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত। আমার কাজ যেমন হার্লানকে ঠেকানো তেমনি তোমাদের কাজ হল এখন থেকে বেরিয়ে বাইরের জগতের সামনে এই সর্বনাশা পরিকল্পনা ফাঁস করে দেওয়া, বুঝলে?’

     ‘ইয়েস স্যার-’ কপাল ঠুকে সোজা শিরদাঁড়া নিয়ে চিৎকার করে উঠলো এলাইন। আমাদের সবার নজর তার দিকে ঘুরে গেল।

     ‘যদি বেঁচে থাকি, তোমার সঙ্গে আলাদা করে বোঝাপড়া করবো এলাইন,’ কর্নেল মুচকি হাসেন, ‘তবে আপাতত হাতের কাজটা সারি আগে-’

     তিনি সামনে এগিয়ে যান। হার্লান আর কর্নেল মুখোমুখি এসে দাঁড়ান।

     ‘তৈরী?’ হার্লান প্রশ্ন করেন, মাথা নাড়েন কর্নেল, ‘আই এম বর্ন রেডি-’

     শুরু হল দ্বৈরথ।

     এদিকে আমাদের বিস্ফারিত চোখের সামনে দাঁড়িয়ে এলাইন মাথা নিচু করে হাসে, ‘দুঃখিত, আমাকে যতখুশি গালাগাল করতে পারেন তবে কিনা আগে এদের সবাইকে আগে সামলানো দরকার-’ আমরা মুখ তুলে দেখি সুড়ঙ্গ পথে ভেসে আসছে এক দঙ্গল মানুষের কলরোল।

     আনা এবার আমাদের উদ্দেশ্য করে বলে, ‘প্রস্তুত?’ আমার বদলে হালদারমশাই বলে ওঠেন মুঠো বাগিয়ে, ‘জন্ম থিক্যা-’

     শুরু হল আমাদের লড়াইও।

২৪

ঘামে রক্তে

     ‘আমাদের অজান্তে একটা যুদ্ধক্ষেত্র তৈরী হচ্ছে জয়ন্ত-’

     কর্নেল বলেছিলেন।

     আজ মাটির নিচে দুখানা প্রাগৌতিহাসিক জন্তুকে সাক্ষী রেখে সেই যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে আছি আমরা। লড়াই করছি ভবিতব্যের সঙ্গে। পরিচয়ের মুখোশ ছেড়ে বেরিয়ে আসছে অজানা চেহারা। রক্তাক্ত যুদ্ধক্ষেত্রটা আমাকে সবার সত্যিকারের রূপের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। আনাকে জানতাম ভদ্র সভ্য নিরীহ গোছের বিজ্ঞানী হিসেবে, এখন দেখলাম তার জুডোর কেরামতি। এলাইনকে জানতাম বছর পঞ্চাশের বাচাল গাইড হিসেবে, এখন বুঝলাম সে একজন সক্ষম সেনানী, কোন দেশের কে জানে! হালদার মশাই যে এমন রণং দেহি রূপ ধারণ করতে পারেন সেটাই কি আগে জানতাম। তার এলেমেলো লাথিঘুসির সামনে ছত্রখান হয়ে পড়ছে বিদেশী গুন্ডার দল।

     আর আমি? যন্ত্রের মতো হাত পা চালালেও আমার চোখদুটো কেন জানি না কর্নেল আর হার্লানকে অনুসরণ করে চলেছে ক্রমাগত।

     দুজনেই রক্তাক্ত। দুজনেই আহত। দুজনেই অনড়।

     হার্লানের ধাতব মুঠোটাকে কোনওরকমে কাটিয়ে বুড়ো ঘুঘু এঁকে বেঁকে নিজের জায়গা করে নিচ্ছেন। হাতে ছুরি থাকা সত্ত্বেও বিজ্ঞানীকে শুধু হাতের মুঠো দিয়ে কাবু করার চেষ্টায় রত তিনি। আজকের যুদ্ধক্ষেত্রে মানুষ না মারার প্রতিজ্ঞা কি রক্ষা করতে পারবেন কর্নেল? নাকি প্রতিজ্ঞা রক্ষা করার চড়া মাশুল দিতে হবে তাঁকে।

     ‘চড়াক-’  আমি শিউরে উঠি, হার্লানের বায়োনিক হাতের কব্জি থেকে একটা একটা ধারালো ছুরি বেরিয়ে এসেছে।

     ‘আরেকটা চমক কর্নেল,’ বিজ্ঞানী সদর্পে ঘোষণা করেন, ‘দুঃখিত, আমার হাতে সময় কম-’

     ‘যাক, তুমি এখন আমার সমকক্ষ হলে হার্লান-’ কর্নেল ঠোঁটের রক্ত হাতের কব্জি দিয়ে মুছে ঝাঁপিয়ে পড়েন শত্রূর ওপরে। আমি কেঁপে উঠি।

     ‘কর্নেলের ওপর ভরসা রাখো জয়ন্ত-’ আনা ধমকে ওঠে, আমি আবার গুন্ডাগুলোর দিকে নজর দিই।

     ‘রাবনের গুষ্টি-’ হালদারমশাই কাতরে ওঠেন। এলাইন বারবার পকেটে হাত ঢোকাতে গিয়ে নাস্তানাবুদ হচ্ছে, ‘ধুস. বাইরে আমার বন্ধুরা অপেক্ষা করছে, শুধু একটা বোতাম টেপার অপেক্ষা-’ সে আক্ষেপ করে।

     আনা চিৎকার করে, ‘আমাদের মারা যাবার জন্য অপেক্ষা করছো নাকি?’

     এলাইন ব্যাজার মুখে ঘুসি ছুঁড়তে ছুঁড়তে অনুযোগ করে, ‘বোতাম টেপার সুযোগই পাচ্ছিনা যে-’

     ঠিক তখনই একটা আর্তনাদ ভেসে এল!

     গলাটা আমার ভীষণ চেনা।

 

২৫

শেষের শুরু

     আমি মাথা ঘোরাই। রক্ত হিম হয়ে যায় দৃশ্যটা দেখে।

     কাচের দেওয়ালে কর্নেলের টুঁটি চেপে ধরেছেন হার্লান, তাঁর ধাতব হাতের ছুরিটা কর্নেলের ঘাড়ে গোঁজা।

     রক্ত গড়িয়ে পড়ছে ক্ষতস্থান থেকে। কর্নেলের মুখটা বেঁকেচুরে গেছে যন্ত্রনায়। হার্লান এখনও ভাবলেশহীন। তার অন্য হাতটা হাত নেমে আসছে ধীরে ধীরে।

     আমি স্থির হয়ে গেছি। সম্পূর্ণভাবে ভুলে গেছি চারপাশের পরিস্থিতি।

     কর্নেলের ডান হাত শূন্য, একটা ছুরি পড়ে আছে মেঝেতে। খালি হাতটা দিয়ে গলায় চেপে বসা মুঠোটাকে আলগা করার মরিয়া লড়াই চালাচ্ছেন মানুষটা। সেকেন্ডের কয়েক ভগ্নাংশ সময়, তার মধ্যেই ওই বা হাতটা উঠলো এবং নামলো বিদ্যুতের গতিতে।

     আবার আর্ত চিৎকার। তবে এটা হার্লানের।

     কর্নেলের ছুরি বিজ্ঞানীর বাম হাতে বিঁধে আছে। হার্লানের কথাটা শুনতে পাই আমি, ‘আপনি সুযোগ হারিয়েছেন স্বেচ্ছায়, সেখানেই আমি জয়ী, কর্নেল-’ তার হাতটা এবার নেমে আসছে কর্নেলের বুক লক্ষ্য করে।

     ‘অগত্যা-’ কর্নেলের বাম হাত থেকে ডান হাতে ছুরিটা চলে এসেছে কখন সেটা দেখতে পাইনি, এবার সেটার স্থান হল হার্লানের বুকের বাম দিকে। বজ্রাহতের মতো মাটিতে আছড়ে পড়লেন বিজ্ঞানী।

     ‘পেয়েছি-’ এলাইনের গলা শুনতে পেলাম, ‘কোনও চিন্তা নেই, মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই এসে পড়বে আমার বন্ধুরা-’

     আনা আমাদের অপেক্ষা করে না। দ্রুত দৌড়ে যায় হার্লানের দিকে। তাঁর রক্তাক্ত দেহটাকে দুহাতে ধরে মাটিতে বসিয়ে দেয় সে।

     ‘ওরা এসে গেছে-’ এলাইন চিৎকার করে, আমি কাছেই কোথাও অনেকগুলো ভারী বুটের শব্দ শুনতে পাই। গুন্ডাগুলো দৌড়ে পালায়।

     আমরা যুদ্ধে ক্ষান্তি দিয়ে কর্নেলের কাছে যাই, তাকে জড়িয়ে ধরি।

     ‘আমি ঠিক আছি জয়ন্ত।’ কর্নেল বিড়বিড় করেন।

     ‘হার্লান,’ আনার চোখে জল, ‘এ কি হল?’ সে বিজ্ঞানীকে ঝাঁকায়, ‘আমি চিরদিন তোমাকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছি, অথচ আজ-’ কান্নার দমকে তার শরীরটা কাঁপে।

     বিজ্ঞানীর মুখ এখনও ভাবলেশহীন, শুধু ঘামে ভেজা মুখখানা দেখে বোঝা যাচ্ছে তার ক্লান্তির কথা। বারবার ওঠানামা করা কণ্ঠার হাড় বোঝাচ্ছে অভিব্যক্তিহীন মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে থাকা তীব্র যন্ত্রণার অস্তিত্ব।

     ‘এই সুরটা চিনতে পারছো আনা?’ হার্লান এর মধ্যেও ধীর স্থির শান্ত, ‘এর নাম, ‘ও ফরচুনা’। আমার খুব প্রিয়… খুব…. মানুষ… যতই চেষ্টা করুক না কেন… ভবিতব্যকে কেউ খন্ডাতে পারে না… গানটা শেষ মুহূর্তে সেই কথাটাই মনে করিয়ে দিল আনা… দিনের শেষে আমরা সবাই ভাগ্যের হাতে অসহায়-’ আমি গানটার দিকে মনোযোগ দিই। সুরটা কেমন চেনা চেনা লাগছে। হালদার মশাই আমার কানে কানে ফিসফিস করেন, ‘ওল্ড স্পাইসের বিজ্ঞাপন-’

     শৈশবের সেই স্মৃতিটা হঠাৎ বিদ্যুৎচমকের মতো মাথায় খেলে যায়। গানের সুর আস্তে আস্তে চড়া হচ্ছে।

     ‘টোনি, এসব করে কি লাভ হল? কার লাভ হল?’

     ‘আহ, আমাকে অনেকদিন পরে কেউ ছোটবেলার নাম ধরে ডাকলো, বেশ ভালো লাগলো-’ কর্নেলের দিকে নিজের ধাতব হাত বাড়িয়ে ধরেন বিজ্ঞানী, ‘আনা নিতান্ত সরল, ওর কোনও বিপদ হতে দেবেন না কর্নেল, কথা দিন-’ কর্নেল তাঁর হাত মুঠোয় নেন, গম্ভীর স্বরে বলেন, ‘কথা দিলাম টোনি-’

     কর্নেলের হাতের মুঠোয় হাত রেখে হাসেন বিজ্ঞানী, এই প্রথম।

     ‘যাবার আগে আরেকটা পাপ করে গেলাম,’ হার্লান আবার বলে ওঠে, ‘ওদের দরজাটা খুলে দিয়ে গেলাম, আর এই ল্যাবেরটরি সাত মিনিটের মধ্যে ধ্বংস করার নির্দেশটাও বোতাম চেপে চালু করে দিলাম। আমি চাই না আমার রক্তজল করা পরিশ্রম অন্য কেউ নিজের স্বার্থে ব্যবহার করুক। আমি চাই আমার সন্তানরা যেন মুক্ত পৃথিবীতে বাঁচতে পারে বাকি সবার মতোই। আশা করি একদিন আমাকে আপনারা সবাই ক্ষমা করতে পারবেন-’ হার্লানের কন্ঠস্বর থেমে গেল।

     ‘হার্লান-’ কর্নেল চেঁচিয়ে ওঠেন। আমি দেখলাম, দুপাশের দেয়ালে মুহুর্মুহু ধাক্কা মারছে দানব দুটো। ওরাও কি বুঝতে পেরেছে? মাটি ছেড়ে ওদের শরীর দুটো হঠাৎ জল কেটে এগিয়ে গেল, তারপর মিলিয়ে গেল। ওরা মুক্তির গন্ধ পেয়েছে।

     ‘আমাদের হাতে সময় নেই,’ এলাইন চিৎকার করে আমাদের সতর্ক করে, 

     ‘জলদি-’ মিলিটারি উর্দিধারীর দলও আমাদের উদ্দেশ্যে চেঁচিয়ে ওঠে।

     ‘আনা, বিজ্ঞানীকে এখন বিদায় জানাতে হবে-’ কর্নেল আনার কাঁধে হাত দিয়ে তাকে সান্তনা জানানোর চেষ্টা করেন।

     ‘কিন্তু ওঁকে এইভাবে ফেলে রেখে-’ আনার ফোঁপানি থামার নয়।

     ‘টোনি এখানেই বোধহয় সবথেকে স্বচ্ছন্দ। মানুষকে ও ঘৃণা করত, তাই সব জনপদ থেকে মাটির গভীরে এইখানেই ও থাকুক চিরবিশ্রামে।’ কর্নেলের গলাটা ভারী শোনায়।

     ‘জলদি।’ ওরা অধৈর্য হয়ে পড়েছে।

     আনা চোখের জল মুছে হার্লানের দেহটাকে মাটিতে শুইয়ে দেয়, ‘হ্যাঁ, এখনই থাকুক ওঁর সন্তানদের আঁতুড়ঘরে।’ স্বগতোক্তি করে সে।

২৬

সাত মিনিট

     ‘এবার প্রশ্ন একঘন্টার পথ কিভাবে পেরোবো সাত মিনিটে?’ হালদার মশাই কাঁপা কাঁপা গলায় জানতে চান।

     ‘প্রথমে দৌড়ে, তারপর সাঁতরে-’ এলাইন দৌড় শুরু করে দিয়েছে ইতিমধ্যেই, তার পিছনে আমরাও।

     ‘সাঁতরে?’ হালদারমশাই থতমত খেয়ে আমাদের দিকে প্রশ্ন করেন।

     ‘যেখানে সিঁড়িতে চেপেছিলাম সেখানে এখন সমুদ্রের জল ঢুকে গেছে, জোয়ার তো।’ আমি হালদারমশাইয়ের হাত ধরে টান মারি, তিনিও ছুটতে শুরু করেন।

     ‘এই তো, এবার ঝাঁপ-’ বিদেশি সৈন্যরা বিনা বাক্যব্যয়ে ঝপাঝপ জলের মধ্যে লাফিয়ে পড়ে, হ্যাঁ, অস্ত্রগুলোকে গলায় ঝুলিয়েই।

     আমরাও একে একে তাদের অনুসরণ করি। হালদারমশাই দাঁড়িয়ে পড়েন, জলের দিকে তাকিয়ে ঢোক গেলেন কয়েকবার।

     ‘ওখানে যদি ‘ওরা’ থাকে?’ তিনি দিশেহারা।

     ‘থাকলে মৃত্যু-’ কর্নেল হালদারমশাইয়কে মুচকি হেসে ঠেলা মারেন জলে, সেই সঙ্গে নিজেও ডুব মারেন। তাঁকে সাহায্য করতে এগিয়ে যাই আমি আর আনা।

     নীল ঠান্ডা জল। সেই জল কেটে আমরা সাঁতরে চলেছি টানেলে বেয়ে। বারবার ভয়ে মাথা ঘুরিয়ে দেখছি পিছনের দিকে, বিস্ফোরণ ঘটলো কি?

     না, সবকিছুই শান্ত। তবুও আমরা নিশ্চিন্ত হতে পারি না, জোরে আরও জোরে হাত পা ছুঁড়ে গুহামুখ থেকে বেরিয়ে আসি।

     এদিকে আরেক বিপত্তি, গুহার বাইরে ঠান্ডা হাওয়ার গোমরানি, বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটায় দৃষ্টি আচ্ছন্ন। দূরে আকাশের গায়ে কালো মেঘের ঘূর্ণি। সেটাকে ফালা ফালা করে দিয়ে বিদ্যুতের চমক।

     ‘আমরা এসে গেছি-’ কয়েকটা সক্ষম হাত আমাদের টেনে তোলে বোটে।

     চোখ বুলিয়ে ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে আমি দেখে নিই সবাই ফিরেছে কিনা নিরাপদে তারপর স্বস্তির নিশ্বাস ফেলি। সেনাদের দলটাও উঠে পড়ছে ওদের স্পিডবোটে এবং সেগুলো ছুটে চলেছে অন্য দিকে। কোথায় চলেছে ওরা? কে জানে!

     ‘তাড়াতাড়ি হাত চালাও ভাই সকল-’ এলাইনের চিৎকার শোনা যায়। দাঁড়ের শব্দ ছাপিয়ে সেই চিৎকার আমাদের কানে এসে পৌঁছায়, মেরুদন্ড বেয়ে একটা ভয় সরসরিয়ে যায়-’

     ‘আশ্চর্য-’ আনা ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে ফিসফিসিয়ে ওঠে, ‘বিস্ফোরণের কথাটা তাহলে নিছক মিথ্যে?’ তার চোখ হাতে বাঁধা ঘড়ির দিকে।

     এমন সময় হঠাৎ। মৃদু ভূমিকম্পের শব্দে কেঁপে উঠলাম আমরা। একটা বিশাল জলতরঙ্গ উড়ে এলো আমাদের ছোট্ট বোটখানার ওপরে। লাল আগুনের সঙ্গে মেশা কালো ধোঁয়ার পুঞ্জীভূত স্তুপটাকে গুহামুখ থেকে বাইরে বেরিয়ে হাওয়ার সঙ্গে মিশে যেতে দেখলাম আমরা। টালমাটাল বোটে সমুদ্রের ঝাপটানিতে দুলতে দুলতে আমরা বুঝলাম, হার্লান মিথ্যে বলেছিলেন বটে তবে সেটা আমাদের নিরাপত্তাকে নিশ্চিত করতেই।

     দুম-দুম-দুম-

     আবার শব্দ। বাজ পড়ছে নিশ্চয়!

     আনা আমার কব্জি ধরে টানে আকাশের দিকে আঙ্গুল তুলে দেখায়। কালো মেঘের ঘূর্ণির কাছটাতে বিদ্যুৎ চমকের আলোয় দেখা যাচ্ছে কয়েকটা উড়ন্ত যুদ্ধবিমানকে। তাদের শরীর থেকে ছিটকে বেরোচ্ছে আগুনের ফুলকি, সেগুলো ছুটে যাচ্ছে সমুদ্রের জলতল লক্ষ্য করে, আলোর চমকে কেঁপে উঠছে অশান্ত সমুদ্র।

     দুম- দুম- দুম- আরও কয়েকবার।

     এরপরেই একটা পরিচিত অমানবিক চিৎকার। সেই প্রাগৈতিহাসিক হাঁড়কাঁপানো শব্দ। জল তোলপাড় করে একটা অতিকায় প্রাণীর সমুদ্র থেকে লাফিয়ে উড়োজাহাজটাকে ধরার চেষ্টা এবং প্রতিটা যুদ্ধবিমান থেকে একযোগে প্রাণীটাকে লক্ষ্য করে আগুনবৃষ্টি- পুরো ঘটনাটা চোখের সামনে ঘটতে দেখলাম কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে।

     আমি নিশ্চিত হলাম, এটা বিজ্ঞানীর দ্বিতীয় সন্তান- নসিথিউস।

     বিকট কন্ঠ আবার ভেসে এলো, কেমন যেন কান্নার মতো শোনালো শব্দটা। আনা দুহাতে কান চেপে ধরে ডুকরে ওঠে, ‘ওহ, দুঃসহ-’

     দ্বিতীয় সন্তান লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু প্রথমটা কোথায় গেলো? তাকে কি ওরা এর মধ্যেই খতম করে দিয়েছে?  প্রাণীদুটো  কতক্ষণ যুঝবে এই দুর্দান্ত যান্ত্রিক শক্তির সঙ্গে?

     আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলি।

 

২৭

সত্যি কথা

     সকাল হয়েছে, ঝড় থেমেছে। সবরকম গ্লানি মুছে আকাশ আবার ঝলমলে রোদ মেখে মিটিমিটি হাসছে।

     আমাদের মধ্যেও যতরকম কুয়াশা ছিল, সেগুলোও পরিষ্কার হয়েছে। কর্নেল এলাইনের গুপ্ত পরিচয় আগেই জানতেন, সে কথা কফির কাপে চুমুক দিয়ে ঘোষণা করেছেন। আমাদের ছদ্মবেশী গাইড মাথা নিচু করে শুনেছেন সে কথা। কর্নেল জানিয়েছেন, ফ্রেঞ্চদের মধ্যে খুব  বিখ্যাত একটা রসিকতা আছে কয়েকটা নাম নিয়ে। এলেইম তার মধ্যে একটা, যার আসল মানে হল, ‘অপ্রত্যাশিত-’ এধরণের নাম সাধারণত পরিচয় গোপন করতেই ব্যবহার হয় বেশি। তাই প্রথমেই কর্নেলের নজরে আমাদের হাসিখুশি পথপ্রদর্শকের মিথ্যে ধরা পড়ে যায়। এর পরে দু’বার গল্পের ঝোঁকেই এলাইন নিজের আসল নাম বলে ফেলেন।  আমরা ভুলে গেছি অথবা লক্ষ্য করিনি সেটা। এরপর বিজ্ঞানীর সামনে যখন কর্নেল আমাদের সামনে যুদ্ধের পরিকল্পনা শোনাচ্ছিলেন তখন থাকতে না পেরে এতদিনের শেখানো অভ্যাস মতোই তিনি স্যালুট করে বসেন কর্নেলকে। আমাদের সমানেই তার মুখোশ খুলে যায়।

     ‘তোমাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই, ফ্রেঞ্চ ক্যাভেলরির ইন্টেলিজেন্স শাখার ভারপ্রাপ্ত মেজর মসিয়েঁ জ্যাঁ মৌলীন-এর সঙ্গে-’ কর্নেল শ্লেষের সঙ্গেই বলেন। মাথা নিচু করেই আমাদের অভিবাদন জানায় জ্যাঁ।

     ‘ইয়ে… সব কথা মিথ্যে বললেও… একটা কথা কিন্তু আমি সত্যি বলেছি,’ ভদ্রলোক আমার দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলেন, ‘একসময় সত্যি সাংবাদিকদের সঙ্গে কাজ করেছিলাম, বিশ্বাস করুন-’ আমি এর মধ্যেও হেসে ফেলি।

     ‘আরেকটা মিথ্যে আছে, সেটা ওর বয়েস,’ কর্নেল বলেন, ‘জানলে খুশি হবে উনি পঞ্চাশ বছরের বৃদ্ধ নন। ওর বয়েস আসলে সাতাশ, জয়ন্ত তোমরা দুজনে ভালো বন্ধু হতে পারো-’

     ‘নিশ্চয়ই-’ আমরা হাত মেলাই।

     ‘আসলে আটলান্টিক সমুদ্রের ব্যাপারে ইউরোপের সবকটা দেশ প্রচন্ড রকমের স্পর্শকাতর। সমুদ্র দানবের আবির্ভাব থেকে আমাদের দেশের সরকার ব্যাপারটা খতিয়ে দেখার জন্য আমাকে নিয়োগ করেন। আমার কাজ ছিল ওমেগা কর্পের সাহায্য নিয়ে এমন একজনকে খুঁজে বের করা যে কিনা আমাদের কাজে লাগতে পারেন- ‘

     আনা হাত তুলে দেখায়, ‘আমিই সেই মূর্খ, তাই তো?’

     এলাইন ক্ষমাপ্রার্থী দৃষ্টিতে আনাকে বলে, ‘আমাদের উপায় ছিল না, এতগুলো দেশের স্বার্থ এর সঙ্গে জড়িয়ে যে সব কথা খুলে বললে কেউই আমাদের সাহায্য করতো না। আনা যখন আপনাদের সঙ্গে পর্যটক সেজে বিজ্ঞানীকে খুঁজে বার করতে সচেষ্ট, আমি তখন আপনাদর নিরাপত্তা নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। আমার ওপরে নির্দেশ ছিল আপনাদের তদন্তে নাক না গলিয়ে আপনাদের সবরকম সাহায্য করতে। আমি সেটুকুই পালন করেছি মাত্র।’

     কর্নেল কফির কাপটা শেষ করে টেবিলে রাখেন, তিনি নির্বাক।

     ‘কিন্তু আমাদের কাজটা তো তোমরা নিজেরাই করতে পারতে?’ আনা প্রশ্ন করে। ‘পারতাম হয়তো, কিন্তু সময় লাগতো অনেক বেশি, আর তাছাড়া সরকারি দপ্তরে প্রতিটা পদক্ষেপ নিতে দরকার হয় অসংখ্য অনুমতির আর সেগুলো পেতে পেরোতে হয় অজস্র লাল ফিতের বাঁধন। তার ওপর জানাজানি হলে থাকে বিভিন্ন দেশের সামনে জবাবদিহির ঝামেলা।’ সে ব্যাখ্যা করে।

     ‘আমাদের নিয়ে সেসবের ঝামেলা ছিল না-’ হালদার মশাই বলেন।

     ‘ঠিক তাই-’ এলাইন মুচকি হাসে।

     ‘আপনাদের সঙ্গে গুহায় ঢোকার আগেই আমি সবকিছু জানিয়ে এসেছিলাম। ওরাই আমাদের সাহায্য করতে ঘড়িটা দেয়। তবে ওদের কোনও ধারণাই ছিল না যে শেষ অব্দি ঘটনা এতদূর গড়াতে পারে। তবুও সবাই প্রস্তুত ছিল আমার সংকেতের অপেক্ষায়-’ সে নিজের মাতৃভূমির সেনাবাহিনীর গর্বে গর্বিত সেটা ওর কথাতেই পরিষ্কার।

     ‘আর হার্লানের সন্তানদের কি খবর?’ কর্নেলের প্রশ্ন।

     ‘ওহ আর বলবেন না-’ এলাইন ক্লান্তভাবে বলে, ‘বড় ভাই কাল রাতে বীভৎস লড়াই চালিয়েছে, প্রায় একঘন্টা ধরে তার ওপরে গোলা-গুলি-গ্রেনেড ছুঁড়ে শেষ অব্দি তাকে মেরে ফেলা গেছে। ছোট শয়তানটাও মৃত, তবে তার মৃত্যু নিশ্চিত করতে পারা যাচ্ছে না এখনও-’

     কর্নেল উঠে বসেন সোজা হয়ে, ‘তার মানে তুমি বলছো, সে পালিয়েছে?’

     ‘পালিয়েছে বলিনি, তবে তার মৃতদেহ খোঁজার কাজ চলছে এখনও-’ এলাইন মৃদু কেশে উত্তর দেয়।

     ‘মৃতদেহটা কোথায় এখন? ওটা নিয়ে তোমাদের কি পরিকল্পনা?’ কর্নেল প্রশ্ন করেন।

     ফ্রেঞ্চ সেনাবাহিনীর মেজর এবার নির্বাক থাকেন, ‘সেটা ক্লাসিফাইড, দুঃখিত কর্নেল।’

     বুড়ো ঘুঘু হাসেন বিষণ্ণ মুখে, ‘তোমরা সবাই সমান।’

     ‘সরকারের তরফে আমাকে বলা হয়েছে আপনাদের অনুরোধ করতে যাতে আপনারা হার্লানের গবেষণাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে আমাদের সাহায্য করেন।’ এলাইন মাথা নিচু করে নিঃশব্দে উত্তরের অপেক্ষা করে।

     ‘আমি এসবের মধ্যে নেই।’, কর্নেলের পরিষ্কার উত্তর।

     ‘আমিও পারবো না-’ আনাও মাথা নাড়ে।

     ছদ্মবেশী যেন খুশি হয়, ‘আমিও সেটাই ভেবেছিলাম। আপনাদের গায়ে কোনও রাজনৈতিক রং মানায় না।’ সে বলে।

     ‘এবার তবে আসি?’ সৈনিক উঠে দাঁড়িয়ে মেরুদন্ড সোজা করে ঘোষণা করে, ‘গুড বাই এন্ড গুড লাক।’

     ‘আমাদের সবার নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করে জন্য তোমাকে ধন্যবাদ, এলাইন।’ কর্নেল বলেন।

     ‘এলেইন নয়, জ্যাঁ,’ সে হাসে, কর্নেল মাথা নাড়েন, ‘উঁহু, আমাদের কাছে তোমার পরিচয় ওটাই।’

     টুপি খুলে এলেইন অভিবাদন করে, ‘বিদায়-’ বড় বড় পা ফেলে সে দরজা দিয়ে উধাও হয়।

২৮

এক জোড়া ডানার গল্প

     কর্নেলের বসার ঘরে আবার আমরা এসে বসেছি। ষষ্ঠীদার বানানো কফিতে আরামের চুমুক দিয়ে বুড়ো ঘুঘু মিটিমিটি হাসছেন অনবরত। হালদার মশাই এখনও মাল্টার নৈসর্গিক সৌন্দর্যে বিভোর হয়ে আছেন। ষষ্ঠীদাকে বারবার সেখানকার ছোটখাট বৃত্তান্ত উত্তেজিত হয়ে শুনিয়ে চলেছেন।

     ‘আচ্ছা কর্নেল, আপনার কাছে আমার দুটো প্রশ্ন আছে।’ আমি থাকতে না পেরে প্রসঙ্গটা টেনে বার করি।

     ‘করে ফেল ডার্লিং-’ কর্নেল বরাভয় দেন।

     ‘ভ্যালেত্তা এয়ারপোর্টে আপনার কাছে একটা ফোন এসেছিল, সেটা কার?’

     ‘এলাইনের বড় কর্তার। ধন্যবাদ জানিয়েছেন ওঁরা। যেহেতু পুরো মিশনটাই হয়েছে লোকচক্ষুর আড়ালে, তাই আমাদের কোনও পুরস্কার দেবার উপায় নেই ওদের। কিন্তু তার পরিবর্তে-’

     হালদারমশাই ষষ্ঠীদাকে ছুটি দিয়ে সামনে ঝুঁকে পড়েন, ‘পরিবর্তে?’

     কর্নেল মুচকি হাসেন, ‘ওরা আমাকে দিয়েছে দুটো বিশেষ অনুমতি-’

     ‘কি অনুমতি?’ আমি চিৎকার করে উঠি উল্লাসে।

     ‘সেটা এখন বলবো না, সময় হলেই জানতে পারবে। এবার এস তোমার দ্বিতীয় প্রশ্নে-’ কর্নেল মুখে তালা দিলেন।

     ‘প্লেনে ওঠার সময় আমি পরিষ্কার দেখেছি আপনি একটা ছোট্ট বাক্স ব্যাগ থেকে বার করে পকেটে ঢোকালেন, ওটা কি ছিল?’

     ‘আমার এনগেজমেন্ট রিং ডার্লিং-’ কর্নেলের মস্করা শুনে সবাই হাসলেও আমি হাসি না।

     ‘আচ্ছা, তাহলে সত্যিটাই বলি,’ কর্নেল পকেট থেকে বার করেন ছোট্ট বাক্সটা, আমরা এগিয়ে গিয়ে ডালাটা খুলি। বাক্সের মধ্যে চকচক করে ওঠে একটা পেনড্রাইভ।

     ‘এটা তো -’

     ‘হ্যাঁ, জয়ন্ত, পেন ড্রাইভ। এর মধ্যেই আছে প্রফেসর হার্লান এলিসনের সমস্ত পরীক্ষা নিরীক্ষার ফলাফল। বুঝলে?’ কর্নেল আবার সযত্নে বাক্সটাকে পকেটে ভরেন।

     ‘আপনি কি করে হাতালেন এটা? আমি তো ভেবেছিলাম ফরাসি সরকার এসব হাতে পেলে-’ আমার কথা থেমে যায়।

     ‘হাতাইনি বন্ধু, বিজ্ঞানী নিজের হাতে ওটা আমাকে দিয়েছেন,’ কর্নেলের গলা বিষণ্ণ শোনায়, ‘হাত মেলানোর অছিলায়-’

     ‘কিন্তু তিনি আনার হাতেই তো দিতে পারতেন ওটা, তাই না?’ আমি জিজ্ঞাসা না করে পারি না।

     ‘বিজ্ঞানীর শেষ কথাটা মনে আছে তো জয়ন্ত,’ কর্নেল হাসেন। ‘আনা বড় সরল মানুষ-’ আমি বলে উঠি।

     ‘সরল মনের মানুষ বলেই তাকে ব্যবহার করে ফরাসি সরকার বিজ্ঞানীর গোপন কর্মকান্ডের গোড়ায় পৌঁছে গেছিলো, তাই না?  হার্লান বোধহয় সেই জন্যই মেয়েটার ওপরে ভরসা করেননি এই ব্যাপারে। আর তাছাড়া আনার উপরে অজস্র বিপদও আছড়ে পড়তে পারে এরকম একটা তথ্য সঙ্গে থাকলে। তাই…’ কর্নেল থামেন।

     ‘এবার এটা দিয়ে কি করবেন?’

     ‘আমি নিরীহ পাখপাখালির খবর রাখি। ডায়নোসরদের নিয়ে নাড়াঘাটা করাটা আমার এক্তিয়ারে পড়ে না। তাই এই পেনড্রাইভটা দিয়ে যাবো এমন একজন মানুষকে যিনি একাধারে একজন দরদী বিজ্ঞানী। তিনি এই গুপ্তবিদ্যাকে প্রহরা দেবেন এবং পৌঁছে দেবেন এমন হাতে যিনি কিনা এর তথ্য মানুষের কাজে ব্যবহার করতে পারেন-’

     ‘কে আছেন এমন মানুষ?’ আমি কর্নেলের দিকে ঝুঁকে প্রশ্ন করি।

     ‘টাকমাথা আর দাড়িওয়ালা শুধু একজন মানুষকেই তুমি চেনো না জয়ন্ত-’

     ‘প্রফেসর শ-’ আমি অনেক কষ্টে নিজেকে নিবৃত্ত করি চেঁচিয়ে ওঠা থেকে। আমাকে ঠোঁটে আঙ্গুল দেখিয়ে অট্টহাসিতে ফেটে পড়েন বৃদ্ধ সান্তা ক্লজ।

     ‘এবার আমার তৃতীয় এবং শেষ প্রশ্ন,’ আমি কর্নেলের চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করি, ‘হার্লান তাঁর সন্তানদের ওরকম বিদঘুটে নাম কেন রেখেছিলেন কেন?’

     কর্নেল আরাম করে চুরুট ধরান, ‘গ্রিক পুরাকাহিনী অনুসারে ‘নসিনাস’ আর ‘নসিথিউস’- ওডিসিউস আর ক্যালিপসোর প্রেমের স্মারক। তাদের দুই সন্তান। হোমার যদিও তাদের কথা লেখেননি তাঁর মহাকাব্যে-’

     হার্লানের নিজের সন্তানদের নাম রেখেছেলিন সেই দুজনের নাম অনুসরণ করে যারা ছিল কাব্যে উপেক্ষিত। হার্লান আমাদের এক মহানায়কের সেই প্রেমের গল্পটা মনে করিয়ে দিতে চেয়েছিলেন যেটা ভুলে যাওয়াতেই সবার মঙ্গল ছিল। মনটা ভারী হয়ে ওঠে।

     চিক-চিক-চিক-চিক্কক্ক-

     আনা ভিতর ঘর থেকে কুলফিকে হাতের মুঠো বন্দি করে হাসিমুখে ঢুকলো বসার ঘরে। এই আওয়াজটা সেই ছোট্ট পালকে ঢাকা প্রাণীটার।

     ‘আহ, কর্নেল, কুলফি তৈরী-’ কর্নেল উঠে দাঁড়ান, আমরাও। ষষ্ঠীদাও হাতে ক্যামেরা নিয়ে বেরিয়ে এসেছে।

     ‘আহা, কাজটা তুমিই করতে পারতে তো-’ কর্নেলের মৃদু আপত্তি ঠেলে সরিয়ে আনা ছোট্ট পাখিটাকে তাঁর হাতে চালান করে দেয় সযত্নে।

     ‘এটা আমার নয়, ওর বাপের কাজ এখন-’ আনা হাসে।

     চিক…চিক…চিক্কক..

     কুলফি মাথা ঘুরিয়ে আমাদের দেখছে আর ডেকে চলেছে। আমরাও ওকে দেখছি চোখ ভোরে।

     ন্যাড়া হাড়গিলে ছোট্ট পাখিটা এখন রঙিন পালকে সেজে উঠেছে, মাথায় এখন একটা সুদৃশ্য লাল টুপির মতো ছোপ ফুটে উঠেছে।

     সকলে মিলে কর্নেলের পিছু পিছু বাগানে এসে দাঁড়াই। হালকা রোদ্দুর গাছের ডালে ডালে খেলছে, পাতায় পাতায় ঠোক্কর খেয়ে পিছলে পড়ছে আমাদের চোখে মুখে।

     ‘চিক…চিক…চিক…’ চারদিকে মাথা ঘুরিয়ে কুলফি ডেকেই চলেছে।

     ‘হতচ্ছাড়া দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসলেই হবে?’ কর্নেল ষষ্ঠীদাকে ধমকে ওঠে, ‘ছবিটা তোল!’

     শুধু ষষ্ঠীদাই নয় আমরাও সবাই কুলফির সঙ্গে ছবি তুলি। সে গর্বিত মুখে আমাদের সমস্ত দাবি মেনে নেয়।

     ‘সময় হয়েছে-’ কর্নেল স্বগতোক্তি করেন, হাতের মুঠোটাকে আস্তে আস্তে ওপরের দিকে তুলে ধরেন, তারপর মুঠো আলগা করেন।

     কুলফি ডানা মেলে। আমাদের মাথার ওপরে কয়েকবার চরকিপাক দিয়েই দ্রুত পাশের ডালিম গাছের ডালে গিয়ে বসে। তার শরীর এতটা পরিশ্রমে কাঁপছে, যদিও চোখ দুটো আকাশের নীল দিগন্তে নিবদ্ধ।

     আমরা হাততালি দিয়ে তাকে উৎসাহ দিয়ে চলেছি অনবরত।

     আমাদের চিৎকার চেঁচামেচিতে বিরক্ত হয়ে অথবা নতুন অভিযানের আহ্বানে সে আবার ডানা মেলে এবং এক উড়ানে আমাদের চোখের সামনে থেকে উধাও হয়ে যায় সুদূরের সীমানায়। আমরা দাঁড়িয়ে থাকি নিঃস্ব নির্জনতা নিয়ে। কর্নেলের চোখদুটো কি সজল হয়ে উঠেছে?

২৯

শেষ নয়

     আবার একটা রবিবার এসেছে। দৈনিক সত্যসেবকে সাহস করে ফোন করেছিলাম, প্রশ্ন করেছিলাম, ‘চাকরিটা আছে?’

     ‘নির্ভর করে তোমার পরের স্টোরিটার ওপর-’ মুখের ওপর ফোন কেটে দিয়েছিল ওরা।

     সেই ‘গল্প’ই লিখতে বসেছি রবিবারের অলস দুপুরে। যদিও কিছুতেই লেখাতে মন বসাতে পারছি না। মন জুড়ে ছায়া আর ছবির নড়াচড়া। বিচিত্র সব অনুভূতির আনাগোনা। কলম তাই থমকে আছে দিগভ্রষ্ট হয়ে। আমি শুধু ভাবছি আর ভাবছি।  ভেবেই চলেছি।

     গতকাল যেমন আনাকে এয়ারপোর্টে বিদায় জানাতে গিয়ে ওর হাতে তুলে দিয়েছিলাম লুকিয়ে কেনা গানের রেকর্ডটা, যেটার ওপর আঙ্গুল রেখে সে বলেছিল, ‘আমার খুব প্রিয়-’ আনা ধন্যবাদ জানিয়েছিল। আমাদের দুজনের মূক বাৰ্তালাপকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে খুব কাছের আকাশ চিরে উড়ান দিয়েছিল একটা উড়োজাহাজ। যাবার আগে আনা জানিয়েছিল সে আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখবে। একটা প্রতিশ্রুতি যেরকমটা আমরা প্রায় প্রতিদিনিই সব্বাইকে দিয়ে থাকি।

     ভেবেই চলেছি। ভাবছি এলাইনের কথাও। কোথায় আছে ও এখন? হয়তো কোনও গোপন অভিযানে সম্পূর্ণ অন্য কোনও পরিচয়ে নতুন ভাবে সেজে উঠেছে সে। যদি কোনওদিন তার সামনাসামনি পড়ে যাই সে আমাকে চিনতে পারবে? যদি তার নাম ধরে ডাকি সে কি মনে করতে পারবে আমাদের খুব পছন্দের ‘ছদ্মনামটা’?

     ভাবছি মৃত হার্লানের কথা। ভাবছি তার দুই সন্তানের কথা। একজন মৃত, অন্যজন নিঁখোজ। নিঁখোজ দানবটা কোথায় আছে এখন? অতল নীল ফুঁড়ে সে কি আবার ফিরে আসবে কোনওদিন? কে জানে?

     আচ্ছা, আনারোজ পাখিটা, মানে আমাদের কুলফি, সেও কি কোনওদিন আমাদের কথা ভেবে আমাদের সঙ্গে দেখা করতে আসবে? বুড়ো ঘুঘুর একলা ঘরটার কথা সে কি ভুলে যাবে বেমালুম? কে জানে!

     ভাবি না, আসলে অপেক্ষা করি।

     অপেক্ষা? কিসের জন্য?

     বুড়ো ঘুঘুর মেসেজের, আনাবেলের ফোনের নাকি আনারোজার ফিরে আসার। জানি না। তবে এটুকু জানি অপেক্ষাটা সত্যিকারের।

কেমন লাগলো জানাতে কমেন্ট করুন এখানে

error: Content is protected !!
Verified by MonsterInsights