Tuesday, March 19, 2024
ধারাবাহিক উপন্যাস

জেমস পটার অ্যান্ড দ্য হল অফ এল্ডারস ক্রসিং – পার্ট ১৩

লেখক: জি নরম্যান লিপার্ট, ভাষান্তরঃ প্রতিম দাস

শিল্পী: মূল প্রচ্ছদ, সুদীপ দেব

ত্রয়োদশ অধ্যায়

পোশাকের রহস্য

ইদিন রাতে ডিনারের পর তিন বন্ধু আবার চলল গ্রিফিন্ডোরের শয়নকক্ষের দিকে। জেমস একবার থামল একটা ছবির কাছে। ছবিতে অতিরিক্ত মোটাসোটা এক গরুর দুধ দোয়াচ্ছে কিছু মহিলা। ছবি থেকে এক মহিলা ওর দিকে তাকিয়ে আছে। তখন জেমস ওই লম্বা এবং কুৎসিত দর্শন মহিলার কাছে জানতে চাইল উনি কী দেখছেন। তিরিশ সেকেন্ড কেটে যাওয়ার পর কোনও উত্তর এল না দেখে, জ্যান আর র‍্যালফ দুজনে অধৈর্য হয়ে দুদিক থেকে জেমসের দুটি হাত ধরে টেনে নিয়ে চলল। শয়নকক্ষে পৌঁছে জেমস ট্রাঙ্ক খুলে জ্যাক্সনের ব্রিফকেসটা বার করল। রাখল বিছানার ওপর আর তিনজনেই তাকিয়ে থাকল ওটার দিকে।

     র‍্যালফ জিজ্ঞেস করল, ‘আমরা কী ওটা খুলব?’

     জেমস মাথা নেড়ে বলল, ‘হ্যাঁ। কারণ আমাদের জানতে হবে যে আমরা ওই পোশাকটাই পেয়েছি, নাকি? সারাদিন একটা প্রশ্ন আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। যদি এমন হয় আমার অনুমান ভুল, ওর ভেতরে যেটা আছে সেটা প্রফেসর জ্যাক্সনের নিজের জামাকাপড়? কিন্তু এটাও মোটেই ভাবতে পারছি না কেবলমাত্র মানুষের মনে একটা কৌতূহল জাগানোর জন্য তিনি সবসময় ওটা বয়ে বেড়াচ্ছেন। তুই সকালে ওঁর মুখ দেখলে বুঝতে পারতিস, যখন উনি ভেবেছিলেন আমাদের ধরে ফেলেছেন। পুরো উন্মাদ মনে হচ্ছিল।’

     জ্যান বিছানায় এক লাফে উঠে বলল, ‘আচ্ছা আমরা যদি ওটা খুলতে না পারি তাহলে কী হবে?’

     জেমস উত্তর দিল, ‘আমার মনে হয় না সেরকম কোনও বিশেষ লক ওতে লাগানো আছে। তাহলে সেদিন ডার্ক আর্টসের ক্লাসে ওটা খুলে যেত না।’

     র‍্যালফ একটু সরে দাঁড়াল, যাতে জেমস ওটার সামনে আসতে পারে। ‘তাহলে আর দেরী করে কী হবে। খুলেই ফ্যাল ওটা।’

     জেমস তালাটার দিকে হাত বাড়াল। যদি না খোলে তাহলে ওরা তিনজন যা যা তালা খোলার মন্ত্র জানে সে সব প্রয়োগ করবে এই ভাবনা মনে নিয়ে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল কেসটার সঙ্গে লাগানো পেতলের তালাটা অতি সহজেই খুলে গেল। এতো সহজে খুলল যে জেমসের মনে হল ওর হাত ছোঁয়ানোর আগেই যেন তালাটা খুলে গেল। বাকি দুজন এটা বুঝতে না পারলেও ও থমকে গেল একটা শিহরনের সঙ্গে।

     র‍্যালফ ফিসফিসিয়ে বলল, ‘কেল্লা ফতে?’ জ্যান ঝুঁকে এল কেসটার ওপর। সামান্য ফাঁক হয়েছে ডালার মুখ।

     জ্যান বলল, ‘কিছুই তো দেখতে পাচ্ছি না। ভেতরটা অন্ধকার। জেমস, ঢাকনাটা খোল। আমাদের দুজনের তুলনায় ওটা তোর কাছে অনেক বেশী দরকারি।’

     জেমস ছুঁয়ে দেখল কেসটাকে, ধরল হাতল দুটো, ওঠাল ওপরের-টাকে। দেখতে পেল কালো কাপড়টার ভাঁজগুলোকে। একটা প্রাচীন ভ্যাপসানো গন্ধ বের হয়ে এল কেসটার ভেতর থেকে। জেমসের মনে হল যেন একটা এক সপ্তাহের পুরনো জ্যাক-ও-লন্ঠনের কুমড়োর ভেতরের ঘ্রাণ নিল। লুনার বলা কথা মনে পড়তেই ও কেঁপে উঠল। উনি বলেছিলেন একসময় এই পোশাকটা একজন মৃত রাজার শরীর মুড়িয়ে রাখার জন্য ব্যবহার হয়েছিল।

     জ্যান চাপা খসখসে কন্ঠে জানতে চাইল, ‘এটাই কী সেটা? আমি তো বুঝতে পারছি না এটা কী?’

     ‘হাত দিস না,’ র‍্যালফ কথাটা বলতে না বলতেই জেমস ওটা ধরে টেনে বার করে আনল। পরিষ্কার দাগহীন কালো পোশাকটার ভাঁজ খুলে গেল মসৃণভাবে। বিরাট বড় পোশাক। জেমসের পায়ের কাছে পোশাকটা স্তুপের আকারে জমে উঠতেই র‍্যালফ আরও খানিকটা পিছিয়ে গেল। আরও কয়েকটা টানের সঙ্গেই পোশাকটার হুড অংশটা জেমসের হাতে এসে গেল। সেটার মাপও বিশাল, গলার কাছে সোনালী বোতাম লাগানো।

     জ্যান মাথা নাড়ল ইতিবাচকভাবে, মুখ ফ্যাকাসে এবং গম্ভীর। ‘সন্দেহের কোনও কারণই নেই যে এটাই সেটা। এবার এটাকে নিয়ে আমরা কী করব?’

     র‍্যালফ ঝট করে বলল, ‘কিছুই না। ওটাকে কেসের মধ্যেই ঢুকিয়ে রাখ জেমস। জিনিসটা মোটেই সুবিধের নয়। ওর জাদুশক্তির অনুভুতি হচ্ছে কী তোদের? আমি নিশ্চিত জ্যাক্সন কিছু সুরক্ষা-মন্ত্র বা যা-ই হোক ওটায় দিয়ে রেখেছেন। তা না হলে ওটার অস্তিত্ব এতদিনে সবাই টের পেয়ে যেত। তাড়াতাড়ি কর, ওটা ঢুকিয়ে রাখ। আমি ওটায় হাত দেব না।’

     ‘একটু দাঁড়া,’ জেমস বলল। র‍্যালফের মতোই ও নিজেও অনুভব করতে পারছে জিনিসটার জাদুকরী প্রভাব, কিন্তু সেটা মোটেই ভয়ানক নয়। শক্তিশালী কিছু নিঃসন্দেহে কিন্তু কৌতূহল উদ্রেককারী। বাইরে আনার পর পোশাকটার গন্ধ এখন বদলে গেছে। যে-টা এক সময় পচা গন্ধের মতো লাগছিল, সেটা এখন মাটির সোঁদা গন্ধের মতো মনে হচ্ছে। সঙ্গে মিশে আছে লতা-পাতা, ভিজে ঘাসের ঘ্রাণ, সঙ্গে কেমন যেন একটা বুনো ভাব। পোশাকটা হাতে ধরে জেমসের এক অবর্ণনীয় অনুভুতি হচ্ছে। মনে হচ্ছে ও যেন ওর নিজের সত্তার অন্তঃস্থলে দাঁড়িয়ে আছে। এই ঘরের মধ্যে দিয়ে বয়ে চলেছে ঠান্ডা জল, যা ঢুকছে জানলার ফাঁকফোকর দিয়ে, নীলচে বরফে নির্মিত বাষ্পের মতো। অনুভুতিটা ক্রমশ বিস্তার লাভ করছে, ছড়িয়ে যাচ্ছে এদিকে ওদিকে। প্রাণ আছে ওই বাষ্পদের। কোনাকৃতিভাবে কুন্ডলী পাকিয়ে উঠে যাচ্ছে ছাদের দিকে। ছড়িয়ে দিচ্ছে নিজেদেরকে ঘরের প্রতিটি প্রান্তে। জেমসের আবছা আবছা মনে পড়ছে ছোটবেলায় পড়া গল্প, যেখানে লেখা ছিল মারলিন ছিলেন প্রকৃতি নিয়ন্ত্রণের মাস্টার। উনি এসব খুব ভালো বুঝতেন। আর ব্যবহার করতেন নিজের শাসন বজায় রাখার জন্য। জেমস বুঝতে পারছে কোনওভাবে সে ওই বিশেষ ক্ষমতাকে উজ্জীবিত করে দিয়েছে, যার চাবিকাঠি গাঁথা আছে এই রেলিক পোশাকের সুতোর বুননে। অনুভুতিটা ক্রমশই পাকিয়ে পাকিয়ে বেড়ে চলেছে। জেমস অনুভব করতে পারছে রাত্রিকালীন প্রাণীদের অস্তিত্ব। অ্যাটিকে লুকিয়ে থাকা ইদুরের হৃৎপিণ্ডের আওয়াজ, জঙ্গলে বাদুড়দের রক্ত-বেগুনী আনাগোনা, শীতঘুমে আচ্ছন্ন থাকা ভাল্লুকদের ঝাপসা স্বপ্ন, এমনকী সাধারণ গাছপালা, ঘাসপাতা সব কিছুর জীবন স্পন্দন। শীতের এই রুক্ষ শুষ্ক দিনেও দের শিকড়ের মতো হাতগুলো জড়িয়ে ধরছে বাঁচার জন্য পৃথিবীর মাটিকে।

     জেমস বুঝতে পারছে ও কী করছে, কিন্তু হাত ওর নিজের নিয়ন্ত্রণে নেই। পোশাকের হুডটা উঠিয়ে চাপাল নিজের মাথায়। পোশাকটা ঝুলে থাকলো ওর কাঁধ থেকে। হুডটা মাথার ওপর দিয়ে নেমে এসে ওর চোখ ঢেকে দিতেই শুনতে পেল জ্যান আর র‍্যালফের চিৎকার। ওরা ঝাপসা হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে, যেন কোনও এক লম্বা পিছল সুড়ঙ্গে। ওরা হারিয়ে গেল।

     ও হাঁটছিল। শুকনো পাতা ওর পায়ের তলায় গুঁড়িয়ে যাচ্ছিল মড়মড় শব্দে। পায়ে জুতো নেই। মাপেও যেন বেড়ে গেছে অনেকটা। একই সঙ্গে শক্তসমর্থ। জোরে একটা নিঃশ্বাস নিল, বুকটা ফুলে উঠল পিপের মতো। বিশাল মাপের মানুষে পরিণত হয়েছে ও। লম্বা পেশীবহুল হাত যেন এক পাইথন। ভারি পা গাছের গুঁড়ির মতো। চারদিকের জীবন্ত জগৎ ওকে ঘিরে আছে। পায়ের তলায় মাটির প্রাণ অনুভুত হচ্ছে প্রতি পদক্ষেপে। এই অরণ্যের উদ্দামতা ওর ভেতর প্রবেশ করছে, ওকে শক্তি দিচ্ছে। কিন্তু সেই উদ্দামতা যতটা থাকা উচিত ছিল তার চেয়ে অনেক কম। জগৎ বদলে গেছে, বদলেই চলেছে। কেউ যেন একে পোষ মানিয়ে নিয়েছে, হারিয়ে গেছে এর শক্তি এবং আদিমতা। সঙ্গে সঙ্গেই কমে গেছে ওর নিজের ক্ষমতাও। যদিও ওর সমকক্ষ কেউ নেই, তবু পৃথ্বী আর তার সম্পর্কের মাঝে সৃষ্টি হয়েছে অনেক অন্ধকার অঞ্চল। যেগুলো বাড়ছে আকারে, প্রতি পদক্ষেপে ওকে থামিয়ে দিচ্ছে, সংকুচিত করে দিচ্ছে ওকে। মানুষের সম্পদ বেড়েই চলেছে, ক্ষতি হচ্ছে পৃথিবীর। বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে উদ্দেশ্যহীন স্থানে। ভেঙে যাচ্ছে আদিমতার জাদুর মায়াচ্ছন্নতা। একটা ক্রোধের সঞ্চার হচ্ছে ওর মধ্যে। সবসময় ও গড়ে উঠতে থাকা মানবসভ্যতা গুলোর কাছে গেছে, ওদের সাহায্য করেছে, অবশ্যই অর্থের বিনিময়ে। কিন্তু এই পরিণতি কল্পনা করতেও পারেনি। ওর ম্যাজিক্যাল ভাইবোনেরা কোনও সাহায্যই করতে পারেনি ওকে। ওদের জাদু ওর থেকে আলাদা। পৃথিবীর সঙ্গে সম্পর্ক থাকার কারণেই ওর জাদুর শক্তি অনেক অনেক বেশী, আবার একই সঙ্গে ওটাই ওর দুর্বলতা। এক শীতল রাগের আগুনে পুড়তে পুড়তে ও এগিয়ে চলল। ওর পথ চলার সঙ্গে সঙ্গেই গাছেরা ওর সঙ্গে কথা বলছিল। কিন্তু ড্রায়াডস আর নায়াডসদের আওয়াজ অনেক ক্ষীণ হয়ে গেছে। ওদের শব্দের প্রতিধ্বনি ভেঙে ভেঙে যাচ্ছে, যা বিভ্রান্তিকর।

     ওর সামনে একটা খোলা স্থান যা কেবলমাত্র চাঁদের আলোতে দেখা যায়। পৃথিবীর বুকে এক পাথুরে রুক্ষতা নিয়ে অবস্থান করছে। ও গিয়ে দাঁড়াল জায়গাটায়, মুখ তুলে তাকাল উপরে। চন্দ্রালোকিত রাতের আকাশ বর্তুল আকৃতি স্থানটিকে আলোয় ভরিয়ে রেখেছে। দেখে মনে হচ্ছে সব যেন সাদা রঙ করা। ওর ছায়া লুটিয়ে আছে পায়ের কাছে, যেমনটা থাকে দুপুরবেলায়। এই জগতে ওর জায়গা নেই কোথাও। ও মানুষের এই সমাজ ত্যাগ করে চলে যাবে। কিন্তু ফিরে আসবে একদিন যে-দিন পরিস্থিতির বদল হবে। বদলে যাবে পারিপার্শ্বিকতা। আবার এ ধরা উপযুক্ত হবে ওর ক্ষমতার ব্যবহারের জন্য। সেই সময়ে ও আবার জাগিয়ে তুলবে পৃথ্বীকে, নবজন্ম দেবে গাছেদের আর তাদের আত্মাদের। ওদের সঞ্জীবিত করবে নতুন শক্তিতে, সঙ্গেই নিজেকেও প্রাণিত করবে নতুনভাবে। আর তখনই সূচনা হবে সামঞ্জস্য সাধনকালের। তার জন্য হয়তো সময় লাগবে কয়েক দশক অথবা শতাব্দী। অথবা অপেক্ষা অনন্ত সময়ের। তাতে কিছু যায় আসে না। আর এই সময়টাতেই থাকবে না ও।

     কাছেই একটা শব্দ হল, অসংলগ্ন পদচারণের। কাছে পিঠেই কেউ আছে, এই বিশেষ ফাঁকা জায়গায়। এমন কেউ যাকে সে পছন্দ করে না। কিন্তু ওকেই প্রয়োজন। এই মানুষটার সঙ্গে যখনই সে কথা বলে তখনই এ জগৎটা নিস্প্রভ হয়ে যেতে থাকে, অন্ধকার ঘনিয়ে আসে, ঝাপসা হয়ে যায় সব।

     ‘ওদের বলবে সব যেন মেনে চলে। আমার বস্ত্র, আসন আর দন্ড প্রস্তুত রাখবে। আমি অপেক্ষায় থাকব। যখন আমার ফিরে আসার সময় হবে, হল অফ এল্ডারস ক্রসিং-এ সব একত্র করবে। আমি ঠিক বুঝতে পেরে যাব। অ্যাস্ট্রামাড্ডুক্স, আমি তোমায় বেছে নিয়েছি এই লক্ষ পালনের জন্য। তুমি আমার শেষ সহকারী শিষ্য, তোমার আত্মা আমার হাতের মুঠোয়। তুমি এই কাজ করার জন্য বাধ্য। যতদিন না লক্ষ্যপূরণ হয়। আমার কাছে শপথ নাও।’

     দূরবর্তী অন্ধকার থেকে একটা কন্ঠস্বর শোনা গেল, ‘এটাই আমার ইচ্ছে এবং সৌভাগ্য প্রভু।’

     কোনও উত্তর ভেসে এল না। সে চলে গেছে। তার পোশাক পড়ে আছে মাটির ওপর, ফাঁকা। ওর জাদুলাঠিটা কিছু সময়ের জন্য খাড়া দাঁড়িয়ে থাকল, তারপর সামনের পাথুরে জমিতে আছড়ে পড়ার আগেই একটা হাত সেটাকে ধরে নিল। একটা অদ্ভুত রকমের সাদা রঙের হাত, যে হাতের অধিকারী আ্যস্ট্রামাড্ডুক্স। চকিতেই পুরো দৃশ্যটা কে যেন মুছে দিল অদৃশ্য হাতে। অন্ধকারময়তা সংকুচিত হয়ে এল একটা ঘূর্ণায়মান বিন্দুতে। সমগ্র বিশ্বচরাচর পরিণত হল এক রাক্ষুসে গোলকে, ঘুরতে থাকলো সজোরে, তারপর মিলিয়ে গেল।

     জেমস অতিকষ্টে চোখ খুলে হাঁফাতে থাকল। ওর ফুসফুস মনে হচ্ছিল বায়ুশূন্য হয়ে গেছে। যেন বেশ কিছু সময়ের জন্য ওখানে কোনও শ্বাসপ্রশ্বাসের কাজ সংগঠিত হয়নি। কেউ ওকে ধরল, মাথা থেকে নামিয়ে দিল হুডটা, টেনে সরিয়ে দিল পোশাকটা কাঁধের ওপর থেকে। একটা অসীম দুর্বলতা জেমসকে ঘিরে ধরছিল, ও জ্ঞান হারাচ্ছিল। জ্যান আর র‍্যালফ ওকে ধরে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিল বিছানায়।

     ‘কি হয়েছিল?’ জেমস জানতে চাইল, জোরে জোরে শ্বাস নিতে নিতে।

     ভয় মেশানো কন্ঠে র‍্যালফ বলল, ‘সেটা তো তুই বলবি আমাদের!’

     জ্যান যেমন তেমন করে পোশাকটা ব্রিফকেসে ঢুকিয়ে দিয়েছে। ‘ওই ভয়ানক জিনিসটা তুই যেই পড়লি সঙ্গে সঙ্গেই অদৃশ্য হয়ে গেলি! ছিলি না এখানে কোথাও। কিছু না জেনে ওটা ব্যবহার করাটা তোর মোটেই ঠিক হয়নি, বুঝলি।’

     ‘আমি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম?’ জেমস জানতে চাইল, অনেকটাই ধাতস্থ হয়ে।

     র‍্যালফ বলল, ‘অজ্ঞান হলে তো ভালো হতো। তুই অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিলি। ফুসসস।’

     জেমসের অবাক হওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে জ্যান সম্মতির স্বরে বলল, ‘একদম। তিন চার মিনিটের জন্য তোর কোনও অস্তিত্বই এখানে ছিল না। আর তখন ওর আবির্ভাব হল’ জ্যান উৎকণ্ঠার দৃষ্টিতে জেমসের বিছানার পেছনের কোনাটা দেখাল। জেমস তাকাল, ওখানে দাঁড়িয়ে আছে আবছায়া আকৃতিসহ সেড্রিক ডিগরি। ভূতটা ওদের দিকে তাকাল, হাসল আর কাঁধ ঝাঁকাল। সেড্রিককে অনেকটাই বেশী জমাট বলে মনে হল জেমসের, আগে যে ক-বার দেখেছে তার তুলনায়।

     জ্যান বলে চলল, ‘দেওয়াল ভেদ করে উনি এলেন, মনে হল যেন তোর সঙ্গেই দেখা করতে এসেছেন। র‍্যালফ তো ঠকঠক করে কাঁপছিল। যাই হোক আমি ওকে বললাম, আরে একটা ভূত ওটা। যেমনটা রোজ দেখিস ব্রেকফাস্টের সময়, বা মঙ্গলবারে ইতিহাসের ক্লাসরুমে। যদিও এগুলো কোনও কাজে এল না।’

     র‍্যালফ বলল, ‘উনি আমাদের দুজনের দিকে তাকালেন একবার, তারপর ব্রিফকেসটার দিকে, তারপর যাকে বলে মিলিয়ে গেলেন। এরপর যেটা হল, সেটা তোর আবির্ভাব। ঠিক ওইখানটায়, একেবারে সাদা স্ট্যাচুর মতো।’

     জেমস সেড্রিকের ভুতের দিকে ঘুরল, ‘আপনি কী করেছেন?’

     সেড্রিক মুখ খুললেন কথা বলার জন্য বেশ খানিকটা সময় নিয়ে। মনে হল অনেক অনেক দূর থেকে ভেসে এল ওঁর স্বর। জেমস জানে না শব্দগুলো কানে শুনছে নাকি সরাসরি মনের মধ্যে অনুরনিত হচ্ছে।

     “তুমি বিপদের মধ্যে ছিলে। তাই আমায় পাঠানো হয়েছিল। আমি ওখানে গিয়ে দেখেছি কী হয়েছে।”

     ‘ওটা কী ছিল?’ জেমস জানতে চাইল। কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া ঘটনার রেশ এখনও ওর স্মৃতিতে আছে ঝাপসাভাবে। যদিও কেন জানিনা মনে হচ্ছে জাদুর প্রভাব কেটে গেলে আরও ভালোভাবে সব মনে করতে পারবে।

     “এক চিহ্নিত দ্বারপ্রান্ত। এক অতি শক্তিশালী জাদু, যা খুলে দেয় একটা অন্য ডাইমেনশনের প্রবেশপথ। যার মাধ্যমে অনেক দূরবর্তী সময়ের কোনও মেসেজ বা সিক্রেট জানতে পারা যায়। কিন্তু এর শক্তির কোনও সীমা পরিসীমা নেই। ওটা তোমাকে প্রায় গিলে নিয়েছিল আর একটু হলেই।”

     জেমস জানে এটা কতটা সত্যি। অনুভব করতে পেরেছিল সেটা। শেষের দিকে অন্ধকার ছিল অবিমিশ্র, অনাদি শোষকের মতো। গলার মধ্যে একটা শক্ত দলার অনুভব নিয়ে প্রশ্ন করল, ‘আমি ফিরে এলাম কী করে?’

     সেড্রিক মামুলিভাবে জবাব দিলেন, “আমি তোমায় খুঁজে পেলাম। ডুব দিলাম ইথারের দুনিয়ায়। ওখানেই তো মরার পর থেকে সবচেয়ে বেশী সময় কেটেছে আমার। তুমি ওখানেই ছিলে। কিন্তু অনেক অনেক দূরে। আমি ধেয়ে গেলাম এবং ফিরিয়ে নিয়ে এলাম।”

     ‘সেড্রিক, অসংখ্য ধন্যবাদ আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসার জন্য।’ বলতে বলতেই নির্বোধের মতো পোশাকটা পরার কারণে কী হতে যাচ্ছিল সেটার কথা ভেবে ভয়ে কেঁপে উঠল জেমস।

     “এটা তোমার পাওনা ছিল। তোমার বাবার কাছে আমি ঋণী। একবার সে-ও আমাকে ফিরিয়ে এনেছিল।”

     জেমস বলল, ‘আরে, তুমি তো এখন কথা বলতে পারছো?’

     সেড্রিক হাসলেন, আর এটা ছিল একটা সত্যিকারের হাসি যা জেমস প্রথমবার দেখল ওই ভূতের মুখে। “আমার দারুণ লাগছে… একেবারে অন্যরকম… শক্তিশালী। অনেক অনেক… এখন, যে কোনওভাবেই।”

     র‍্যালফ হাত তুলে বলল, ‘জেমস তুই আমাদের এই ভূতের কথাই বলেছিলি, তাই না? কয়েকমাস আগে যে মাঠের মধ্যে অনুপ্রবেশকারীর দিকে তাড়া করে গিয়েছিল?’

     ‘হ্যাঁ এর কথাই বলেছিলাম,’ জেমস বলল। ‘জ্যান, র‍্যালফ, ইনি সেড্রিক ডিগরি। সেড্রিক এরা আমার বন্ধু। তা আপনার সঙ্গে ঠিক কী ঘটেছে বলে মনে হয়? এখানে নিজেকে অন্যরকম মনে করার মতো কী এমন ঘটল?’

     সেড্রিক আবার কাঁধ ঝাঁকালেন। “অনেক অনেকদিন ধরে আমার কেন জানি না মনে হচ্ছে, আমি একটা স্বপ্নের মধ্যে ছিলাম। দুর্গের দেওয়াল ভেদ করে যাতায়াত করছিলাম, কিন্তু ওটা ছিল একেবারে ফাঁকা। আমার খিদে পাচ্ছিল না। ছিল না তৃষ্ণাবোধ। ঠান্ডা লাগতো না। ক্লান্তি কাকে বলে বুঝতেই পারছিলাম না। আমি জানতাম আমি মরে গেছি, কিন্তু ব্যাস ওইটুকুই। সবকিছু অন্ধকার, নিস্তব্ধ… দিন-রাত বা ঋতুর কোনও অস্তিত্ব নেই। সময় বলেই যেন কিছু নেই। তারপরই সব বদলাতে শুরু করল।”

     সেড্রিক ঘুরে এসে বিছানায় বসলেন, যদিও তার কোনও ছাপ পড়ল না কম্বলের ওপর। জেমস একেবারে কাছে থাকার জন্য অনুভব করতে পারছিল, একটা ঠান্ডা প্রবাহ বয়ে আসছে সেড্রিকের অবয়ব থেকে। আবার বলা শুরু করল ভূতটা।

     “এবার সেই সময় এল যখন আমি চারপাশটা সচেতনভাবে অনুভব করতে শুরু করলাম। অনেক লোকজনকে হলগুলোতে দেখতে পেলাম, কিন্তু তাদের অবয়ব সব ধোঁয়ায় বানানো মনে হল। আমি ওদের কথা শুনতে পাচ্ছিলাম না। একসময় বুঝতে পারলাম এই অনুভুতিটা ঠিক তখন হচ্ছে যখন আমার মৃত্যুক্ষণটা পার হয়ে যাচ্ছে। প্রত্যেক রাতে নিজেকে আমি সচেতনভাবে ফিরে পাচ্ছিলাম। আমি ওই সময়টা বুঝতে পারছিলাম, কারণ একমাত্র ওই সময়েই আমি অনুভব করছিলাম মিনিট ঘণ্টার সঙ্গে সময়ের বয়ে যাওয়া। গ্রেট হলের বাইরে একটা ঘড়ি দেখতে পেলাম আর সময়ের গতি অনুভব করলাম। প্রত্যেক রাতে নিজেকে দারুণ ভাবে ফিরে পেতে শুরু করলাম কিন্তু দিন হলেই সব ঝাপসা হয়ে যেত। আর তারপরই একদিন সকালে স্পর্শের ক্ষমতা হারিয়ে সবে ঝাপসা হতে শুরু করেছি তখনই ‘ওর’ দেখা পেলাম।”

     জেমস খাড়া হয়ে বসল। ‘অনুপ্রবেশকারীর?’

     সেড্রিক মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন। “আমি বুঝতে পারছিলাম ওর এখানে থাকা উচিত নয়। সঙ্গে সঙ্গেই কেন জানি না আমার মনে হল আমি যদি চাই ওকে নিজের রূপ দেখাতে পারব। ওকে ভয় দেখিয়ে ভাগিয়ে দিলাম।”

     সেড্রিক হাসলেন। জেমসের মনে হল, হ্যাঁ এই সেই হাসি যা ওর ড্যাড দেখতে পেতেন।

     ‘তবুও ওই লোকটা আবার ফিরে এসেছিল’, জেমস বলল। সেড্রিকের হাসিটা অসহায়তায় বদলে গেল।

     “হ্যাঁ, ওই লোকটা ফিরে এসেছিল। আমি দেখেছিলাম এবং আবার ভয় দেখিয়ে তাড়িয়ে দিই। রোজ সকালে আমি ওর জন্য পাহারা দিতাম। একদিন রাতের বেলা একটা জানলা ভেঙে ঢুকল। সেই সময়টায় আমার শক্তি বেশি, তবু আমার মনে হল আমার উচিত অন্য কাউকে একটা জানানো, যে লোকটা দুর্গের ভেতর ঢুকেছে। আর সে জন্যই আমি সেদিন তোমার কাছে এসেছিলাম। তুমি আমায় দেখতে পেয়েছিলে, আর আমি জানতাম তুমি কীরকম ছেলে। জানতাম তুমি সাহায্য করবে।”

     জ্যান হাসির সঙ্গে বলল, ‘সেই রাত, যে দিন তুই স্টেইন্ড গ্লাসের জানলাটা ভেঙেছিলি। ব্রুস লীর মতো লাথি মেরে লোকটাকে ফেলে দিয়েছিলি। দারুণ।’

     ‘ওটা কে ছিল?’ জেমস জানতে চাইল কিন্তু সেড্রিক মাথা নাড়লেন। উনি জানেন না।

     ‘এখন তো প্রায় সাতটা বাজে,’ র‍্যালফ বলল। ‘আপনি এখন আমাদের দেখা দিচ্ছেন কীভাবে? এটা তো আপনার শরীর ধারণের সময় নয়?’

     সেড্রিক একটু ভাবলেন। ‘আমি দিন দিন ঘন হচ্ছি, জমাট হচ্ছি। আমি যদিও একটা ভূত, কিন্তু যত দিন যাচ্ছে আমি ভূতের থেকে উন্নত কিছু একটাতে পরিণত হচ্ছি। আমি এখন অনেক বেশি কথা বলতে পারি। আর সময়ের বন্ধনটাও কমে যাচ্ছে। আমার মনে হয় এভাবেই একটা ঠিকঠাক ভূতের জন্ম হয়।”

     ‘কিন্তু কেন?’ জেমস প্রশ্ন করা থেকে নিজেকে আটকাতে পারল না। ‘কেন একটা ভূতের সৃষ্টি হয়? কেন আপনি এসব থেকে বিদায় নিতে পারেন না, মুক্তি পেতে পারেন না?’

     সেড্রিক জেমসের দিকে তাকালেন। দেখে জেমসের মনে হল হয় সেড্রিক প্রশ্নটার উত্তর জানে না, অথবা যা জানে সেটা ভাসা ভাসা ধরনের। আস্তে করে মাথা নেড়ে সেড্রিক বললেন, ‘আমার সব কাজ শেষ হয়নি। আমাকে আরও অনেক দিন বাঁচতে হতো। ব্যাপারটা এতো তাড়াতাড়ি ঘটে গেল, এতো দ্রূত। আমি শুধু… কিছু করতে পারলাম না।”

     র‍্যালফ জেমসের ট্রাঙ্কের মধ্যে ঢুকিয়ে দিল জ্যাক্সনের ব্রিফকেসটা। তারপর বিছানার এক কোনায় বসে জানতে চাইল, ‘অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার পর তুই কোথায় গিয়েছিলি জেমস, মনে আছে?’

     জেমস একটা বড় করে শ্বাস নিল, অদ্ভুত সফরটা মনে করার চেষ্টা করল। বলল পোশাকটা ধরার পরের অনুভুতিগুলোর কথা। সেই বরফের মতো শীতল হাওয়া, নীল কুয়াশা, জীবজন্তু এবং গাছেদের অনুভব করা। বলল মারলিনের শরীরের মধ্যে অবস্থান করে ও যা দেখেছে সেসব। সঙ্গেই মারলিন কী ভাবছিলেন সে কথাও। জেমস কেঁপে উঠছিল মারলিনের রাগের কথা বলতে গিয়ে। সেবক রূপে থাকা অ্যাস্ট্রামাড্ডুক্স এর শপথ নেওয়ার কথাও জানাল, যতদিন পর্যন্ত সময় না হবে ততদিন অবধি সব রক্ষা করতে হবে। প্রতিটা মুহূর্তের কথা বলে গেল বিস্তারিতভাবে। শেষ করল হাড়হিম করা অন্তিম অন্ধকার মুহূর্তের কথা বলে, যা জেমসকে আবরিত করে নিচ্ছিল, সংকুচিত করে দিচ্ছিল, নিয়ে যাচ্ছিল এক অসীম নেতিবাচক শূন্যতার দিকে।

     জ্যান মনোযোগ দিয়ে সব শুনে হাল্কা চাপা স্বরে বলল, ‘হুম সব কিছুর একটা মানে দাঁড়াচ্ছে।’

     ‘কী?’ জেমস জানতে চাইল।

     ‘মারলিন ওটা কীভাবে করবেন। বুঝতে পারলি না? প্রফেসর জ্যাক্সন এ ব্যাপারে প্রথম দিনের ক্লাসেই তো বলেছিলেন!’ যথেষ্ট উত্তেজিত দেখাল জ্যানকে। চোখ বড় বড় করে পরপর দেখে নিল জেমস, র‍্যালফ আর সেড্রিকের ভূতকে, যে এখনও বিছানায় বসে আছে।

     র‍্যালফ মাথা নেড়ে বলল, ‘আমি কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছি না। আমি তো এ বছরে টেকনোম্যান্সি নিইনি।’

     ‘মারলিন মারা যাননি,’ জ্যান জোর দিয়ে বলল। ‘উনি ডিস্যাপারেট করেছেন নিজেকে!’

     জেমসের মাথায় ঢুকল না ব্যাপারটা। ‘তো কী হল। যে কোনও উইজার্ডই পারেন অ্যাপারেট করতে। এর মধ্যে বিশেষ কী এমন হল?’

     ‘মনে করে দ্যাখ জ্যাক্সন আমাদের কী বলেছিলেন প্রথম দিনের ক্লাসে? অ্যাপারিশন ব্যাপারটা যে উইজার্ড করবেন তার কাছে তা একটা তাৎক্ষণিক ব্যাপার। যদিও এক জায়গা থেকে অদৃশ্য হয়ে অন্য জায়গায় আবির্ভূত হতে বেশ খানিকটা সময় লাগে। সঙ্গে এটাও বলেছিলেন যদি কোনও উইজার্ড কোথায় আবির্ভূত হবেন সেটা আগেভাগে ঠিক করে না নেন, তাহলে ফিরে আসতে পারবেন না। মনে পড়ছে? কোনও এক অনিশ্চয়তায় আটকে যাবেন সেই উইজার্ড।’

     জেমস সায় দিল, ‘হ্যাঁ মনে পড়েছে?’ সে-দিনের কথাগুলো মনে পড়েছে ওর। কিন্তু সূত্রটা কী সেটা ধরতে পারছে না।

     জ্যান এবার অতিরিক্ত উৎসাহের স্বরে বলল, ‘মারলিন নিজেকে কোনও স্থানে ডিস-অ্যাপ্যারেট করেননি। নিজেকে পাঠিয়েছেন সময়ের একটা খাঁজে এবং কিছু নির্দিষ্ট ঘটনার একত্রতায়।’

     র‍্যালফ আর জেমস হতভম্বের মতো তাকিয়ে থাকল। জ্যান বলতে থাকল, ‘তুই তোর ওই স্বপ্নদর্শনের ভিত্তিতে বললি মারলিন অ্যাস্ট্রামাড্ডুক্সকে বলেছিলেন রেলিকগুলো সুরক্ষিত রাখতে এবং অপেক্ষা করতে সঠিক সময়ের। আর সেই সময়টা আসবে কখন, যখন হল অফ এল্ডারস ক্রসিং-এ রেলিকগুলো একসঙ্গে আনা হবে। এবার বুঝলি? মারলিন নিজের আবির্ভাবের জন্য সময় এবং পরিস্থিতি সাজিয়ে দিয়েছিলেন। একেবারে শেষের দিকে তুই বললি মারলিন ডিস-অ্যাপারেট করেছিলেন এক ঘূর্ণায়মান বিন্দুতে,’ জ্যান থামল, ওর মুখে চিন্তার ছাপ। ‘বিগত শতাব্দীর দিনগুলোতে উনি আটকে থেকেছেন সময়ের ফাঁদে, এক সর্বত্র অবস্থানের ভেতর। অপেক্ষা করেছেন সঠিক পরিস্থিতি আসার। ঠিকঠাক বললে ওঁর কাছে সময় প্রায় স্থির হয়েই আছে!’

     র‍্যালফ জেমসের বিছানার কাছে রাখা ট্রাঙ্কটার দিকে তাকাল। বলল, ‘তার মানে ব্যাপারটা সত্যি। ওরা এই কাজটাই করার চেষ্টা করছে যাতে ওরা ওকে ফিরিয়ে আনতে পারে।’

     ‘এখন আর পারবে না,’ জেমস বলল চাপা হাসির সঙ্গে। ‘কারণ পোশাক এখন আমাদের কাছে। সব ক-টা রেলিক না হলে পরিস্থিতি একরকম হবে না। ওরা কিছুই করতে পারবে না।’

     জ্যানের বিশ্লেষণ শোনার পর জেমসের কাছে এখন সব পরিষ্কার হয়ে গেছে। বিশেষ করে শেষ মুহূর্তে দেখা বিশেষরূপে চিহ্নিত দ্বারপ্রান্ত ওর ভাবনায় ভিত্তি দিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গেই এখন পোশাকটির প্রাপ্তি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়েছে। আর সেটা পাওয়ার পথে একের পর এক ভাগ্যের সহায়তা পাওয়াটা ওকে অবাক করছে। একেবারে শেষ মুহূর্তে র‍্যালফের ব্রিফকেসটা পেয়ে যাওয়া। জ্যানের ভিসাম-ইনেপ্সিওর সঠিক ব্যবহার। ওর এখন মনে হচ্ছে কেউ ওদের মারলিনের ফিরে আসার ছক ব্যর্থ করতে পরিচালনা করছে। কিন্তু সেটা কে?

     র‍্যালফ আর জ্যান আলোচনায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে মারলিনের ডিসাপিরেশন নিয়ে। জেমস সেড্রিকের ভূতকে ডেকে বলল, ‘বলছিলাম কী আপনি তো বললেন কেউ আপনাকে পাঠিয়েছিল আমাকে সাহায্য করার জন্য। কে তিনি?’

     সেড্রিক উঠে দাঁড়ালেন, একটু যেন ঝাপসা হয়ে গেল অবয়বটা। জেমসের দিকে তাকিয়ে হাসলেন এবং বললেন, “এমন একজন যার নাম আমার বলা উচিত নয়। যদিও আমার মনে হচ্ছে তুমি অনুমান করতে পারবে। এমন একজন যিনি নজর রাখছেন।’

     স্নেপ, জেমসের মনে হল। ও যখন এগিয়ে যাচ্ছিল চিহ্নিত দ্বারের অনন্ত গহ্বরের দিকে স্নেপের পোরট্রেটই সেড্রিককে পাঠিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু উনি জানতে পারলেন কীভাবে? এটাই ভাবতে থাকল জেমস। ওদিকে জ্যান আর র‍্যালফ ফিরে গেল নিজের নিজের কমন রুমে। গ্রিফিন্ডোরের সদস্যরা যার যার বিছানায় হারিয়ে গেল ঘুমের জগতে। একসময় জেমস ও ঘুমিয়ে পড়ল, ওই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেল না ওই রাতে।

*************

পরের কয়েকটা দিন তিন বন্ধু বিজয়ীর মানসিকতায় স্কুলের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা চালিয়ে গেল। জেমস নিজের ট্রাঙ্কের ভেতর জ্যানের দেওয়া লকিং মন্ত্র দিয়ে ফেলে রেখেছে জ্যাক্সনের ব্রিফকেস, যার ভেতর আছে রেলিক পোশাক। ভিসাম-ইনেপ্সিও মন্ত্রের ওপর অগাধ বিশ্বাস রেখে ওরা বিন্দুমাত্র ভাবছেও না যে কেউ আসল ব্রিফকেসটাকে দেখার কথা ভাববে। জ্যাক্সন হিরাম অ্যান্ড ব্ল্যাটুট এর পেতলের পাত লাগানো একদা পাথর রাখার কাজে ব্যবহার হওয়া ব্রিফকেসটা নিয়েই তার দিনযাপন করছেন। কেউ তাকিয়েও দেখছে না দ্বিতীয়বারের জন্য, ভাবছে না কোথায় গেল সেই কালো ব্যাগ যেটায় লেখা ছিল ওঁর নাম। শনিবার বিকেলে তিন বন্ধু আবার মিলিত হল পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে সে নিয়ে আলোচনার জন্য, গ্রিফিন্ডোর কমন রুমে।

     হোমওয়ার্ক করার ভান করে টেবিলের ওপর ঝুঁকে জ্যান বলল, ‘এখন দুটো প্রশ্ন আমাদের সামনে। হল অফ এল্ডারস ক্রসিং কোথায়? আর তৃতীয় রেলিকটাই বা কোথায়, মারলিনের জাদুলাঠি?’

     জেমস মাথা ঝুঁকিয়ে বলল, ‘আমিও ওইটার কথা ভাবছিলাম। সিংহাসন আছে মাদাম ডেলাক্রয় এর হেফাজতে। পোশাকের দায়িত্ব প্রফেসর জ্যাক্সনের। তৃতীয়টা তিন নম্বর ষড়যন্ত্রকারীর কাছে। আমার অনুমান এখানকারই কোনও মানুষের কাছে ওটা আছে। র‍্যালফের গেমডেক যে চুরি করেছিল নিজের নাম দিয়েছিল অ্যাস্ট্রামাড্ডুক্স, সেই স্লিদারিন হতে পারে বোধহয়, কী মনে হয়? যে ওই নামটা ব্যবহার করেছে, আর এই ব্যাপারটা যদি তার জানা থাকে, তার অর্থ সে এর সঙ্গে যুক্ত।

     র‍্যালফ জানতে চাইল, ‘কিন্তু সেটা কে? আমি দেখিনি কে ওটা নিয়েছিল। ওটা পাওয়া যাচ্ছিল না। যাইহোক মারলিনের জাদুলাঠিটা লুকিয়ে রাখাটা কিন্তু বেশ কঠিন ব্যাপার, তাই না? তুই মারলিনের যা বিবরণ দিলি তাতে লাঠিটা ছ-ফুট তো হবেই। একটা এরকম বড় জিনিস লুকিয়ে রাখবি কীভাবে?’

     জেমস মাথা নেড়ে বলল, ‘আমার ভাবনায় কিছু আসছে না। তবে বলতে পারি র‍্যালফ এটা তোর একটা দায়িত্ব। তোকে নজর রাখতে হবে। টেড তো বলেছে, তুই আমাদের ভেতরের লোক।’

     র‍্যালফ তাকিয়ে থাকল বড় বড় চোখে। জ্যান একটা পারচমেন্টে আঁকিবুকি কাটতে কাটতে বলল, ‘প্রথম প্রশ্নটার উত্তর কে দেবে? হল অফ এল্ডারস ক্রসিং কোথায়?’

     জেমস আর র‍্যালফ একে অপরের দিকে তাকাল। জেমস উত্তর দিল, ‘কোনও ক্লু নেই। এই মুহূর্তে আমার মনে হচ্ছে আর একটা প্রশ্ন নিয়েও আমাদের ভাবতে হবে।’

     র‍্যালফ বিড়বিড় করে বলল, ‘প্রথম দুটোর ঝামেলাই কমল না, এসে গেল তিন নম্বর।’

     জ্যান মুখ তুলে তাকাল, জেমস দেখতে পেল পারচমেন্টে আঁকিবুকি কেটে লুক্কায়িত দ্বীপের গেট আঁকা হয়েছে। ‘তৃতীয় প্রশ্নটা কী?’

     জেমস ফিসফিস করে বলল, ‘ওরা এতদিন কাজটা করেনি কেন? তিনটে রেলিক যদি ওরা পেয়ে গিয়ে থাকেন তাহলে ওরা ওই হল অফ এল্ডারস ক্রসিং-এ গিয়ে মারলিনকে হাজার বছরের ডিসঅ্যাপিরেশন থেকে ফিরিয়ে আনলেন না?’

     এর উত্তর ওদের তিনজনের কাছে নেই, কিন্তু ওরা মেনে নিতে বাধ্য যে এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। জ্যান পারচমেন্টটা উল্টাল, দেখা গেল আরিথম্যানসি ক্লাসে নেওয়া নোট আর ডায়াগ্রাম আঁকা আছে ওখানে। ‘আমি র‍্যাভেনক্লের লাইব্রেরী খুঁজে দেখছি, কিন্তু কুইডিচ, ডিবেট, হোমওয়ার্ক আর কন্সটেলেশন ক্লাবের চাপে দুটো মিনিটও পাচ্ছি না সময় বার করতে।’

     র‍্যালফ নিজের কলমটা নামিয়ে রাখল, পেছনদিকে হেলান দিয়ে হাত টানটান করে দুপাশে ছড়িয়ে বলল, ‘ওটা কেমন চলছে? মানে তুই একমাত্র আমাদের মধ্যে যে মাদাম ডেলাক্রয়ের কাছাকাছি যেতে পারিস। ওঁর হাবভাব কেমন?’

     ‘এক্কেবারে জ্যান্ত জিপসি মমি,” জ্যান উত্তর দিল। ‘ওঁর আর ট্রেলোওনি ম্যামের উচিত ডিভাইনেশন ক্লাসের মতোই এই ক্লাবের পরিচালনার দায়িত্ব ভাগ করে নেওয়া। কিন্তু ওঁরা নিজেদের ঝগড়া নিয়েই ব্যস্ত। ইদানীংকালে কথা কাটাকাটিটা একটু কমেছে। ট্রেলোওনি কেবলমাত্র গ্রহ নক্ষত্রের চিহ্ন ইত্যাদি এঁকে আমাদের দেখান আর নিজে টেলিস্কোপ দিয়ে আকাশ দেখেন। বোঝার চেষ্টা করেন গ্রহাদির হালচাল।’ জেমস, সিবিল ট্রেলোওনিকে চেনে আগে থেকেই, দূরসম্পর্কের পারিবারিক বন্ধু রূপে। ওঁর সম্পর্কে জ্যানের মন্তব্য শুনে একটু হাসল। জ্যান বলতে থাকল, ‘ডেলাক্রয় আমাদের স্টার-চার্ট বুঝিয়ে দেন। তারার বিভিন্ন রকম আলোর ওয়েভলেন্থ মাপা শেখান, যা দিয়ে নাকি বড় সড় ধরনের জ্যোতির্বিদ্যার ঘটনা অনুমান করা যায়।’

     জেমসের মনে পড়ল, ‘আরে তাই তো। মনে পড়েছে। গ্রহদের একত্রে অবস্থান। পেট্রা আর টেড আমায় বলেছিল। ওরা ডেলাক্রয়ের সঙ্গে ডিভাইনেশনের ক্লাস করেছে। যার অর্থ ভুডু কুইন এসব ব্যাপার নিয়ে সত্যিই মাথা ঘামায়।’

     ‘কিন্তু উনি ট্রেলোওনির পুরো বিরোধী, এটা মানতেই হবে। ওর কাছে পুরো বিষয়টা কেবলমাত্র অঙ্ক আর হিসাব-নিকাশ। আমরা জানি কবে কোনটা ঘটবে, কিন্তু উনি তাতে সন্তুষ্ট নন। একেবারে নির্দিষ্ট করে ক্ষণটাকে বার করতে হবে। আমার কাছে যদি জানতে চাস তাহলে বলব সে এক বিশাল খাটুনীর কাজ। এ ব্যাপারে উনি একটু বেশিই বাড়াবাড়ি করেন।’

     র‍্যালফ বলল, ‘আমার তো মনে হয় সব ব্যাপারেই ওঁর বাড়াবাড়ি আছে।’

     জেমস চাপা গলায় বলল, ‘আমার মনে হচ্ছে উনি আমাদের ওপর নজর রাখছেন। আমি বেশ কয়েকবার লক্ষ করেছি উনি আমার দিকে তাকাচ্ছেন।’

     জ্যান ভ্রু উঁচিয়ে চোখ কুঁচকালো। ‘ভুলে যাস না উনি অন্ধ। উনি কোন কিছুই দেখেন না।’

     ‘আমি জানি,’ জেমস অবিচলিতভাবে বলল। ‘কিন্তু আমি নিশ্চিত উনি কিছু একটা জানেন। আমার তো মনে হয় চোখে দেখতে না পেলেও অন্য কোনওভাবে দেখতে পান।’

     র‍্যালফ বলল, ‘শুধু শুধু আমাদেরকে ভয় দেখাস না তো। যা ঘটে চলেছে তাতেই থরহরি কম্প হয়ে আছি। উনি কিছু জানেন না। যদি জানতেন তাহলে এতোদিন কিছু না করে বসে আছেন? অতএব ওঁকে নিয়ে বেশী ভেবে লাভ নেই।’

     পরেরদিন জেমস আর র‍্যালফ হ্যাগ্রিডের সঙ্গে দেখা করতে ওর কেবিনে গেল, গ্র্যাপ আর প্রেচকার খবরা-খবর নেওয়ার ছুতোয়। হ্যাগ্রিড প্রেচকা যে গাড়িটা ভেঙে ফেলেছিল সেটা সারাচ্ছিল। বোঝা গেল ওটা ভেঙে যাওয়ায় ও মোটেই রাগ করেনি।

     হ্যাগ্রিড ওদেরকে ভেতরে নিয়ে গিয়ে চা-বিস্কুট দিয়ে নিজে বসল ফায়ারপ্লেসের কাছে। ট্রাইফ হ্যাগ্রিডের পায়ের কাছে শুয়ে মাঝে মাঝে হাতটা চেটে দিচ্ছিল।

     ‘ওহ, ওদের মধ্যে খুবই ঝামেলা হচ্ছে,’ হ্যাগ্রিড জানালো, দৈত্যদের সম্পর্ক গঠন করার প্রাক পর্বটা সত্যিই খুব রহস্যজনক। ‘গত ছুটিতে ওরা মারামারি করেছে। একটা এল্ক হরিণের চামড়া মৃতদেহ নিয়ে ঝগড়া। গ্র্যাপি মাথাটা নিতে চেয়েছিল, প্রেচকার আবার ওটার শিং দিয়ে গয়না করার শখ।’

     র‍্যালফ চায়ে চুমুক দেওয়া বন্ধ রেখে বলল, ‘এল্ক হরিণের শিং দিয়ে গয়না?’

     ‘না, মানে হ্যাঁ, আমি যদিও গয়না বলেছি,’ হ্যাগ্রিড নিজের বিরাট হাতটা নেড়ে বলল, ‘ব্যাপারটা বেশ গোলমেলে। দৈত্যরা গয়না আর অস্ত্র দুটোর জন্যই একই শব্দ ব্যবহার করে। তবে তোমার হাইট যদি কুড়ি ফুট বা তার বেশি হয় ও দুটো একইরকম কিছুই হয়ে দাঁড়ায়। যাকগে, সে ঝামেলা মিটে গেছে এখন ওরা আবার আগের মতোই আনন্দে আছে।’

     জেমস জানতে চাইল, ‘হ্যাগ্রিড, ওরা কী এখনও ওই পাহাড়ের পাদদেশেই বসবাস করছে?’

     ‘হ্যাঁ সেটাই করছে। প্রেচকা একজন সম্মানীয়া মহিলা। আর গ্র্যাপ, কেনই বা নিজের কুঁড়ে ঘরে ঢুকে বসে থাকবে। একটা দারুণ অগ্নিকুন্ড বানিয়ে নিয়েছে, বারচ গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে বসে সময় কাটিয়ে দেয়। সময় লাগবে ওদের। দৈত্যদের ভালবাসা… কি বলবো, খুব ঠুনকো জিনিস, বোঝা খুব মুস্কিল।’

     র‍্যালফ চায়ের কাপের মধ্যেই কেশে উঠল।

     জেমস প্রসঙ্গ বদলানোর জন্য বলল, ‘আচ্ছা হ্যাগ্রিড তুমি তো অনেকদিন ধরে হগওয়ারটসে আছো। এই স্কুল এবং দূর্গ বিষয়ে অনেক রহস্য তোমার জানা আছে তাই না?’

     হ্যাগ্রিড চেয়ারে একটু নড়েচড়ে বসল। ‘সে তো বটেই। এই চত্বরটাকে আমার মতো কেউ চেনে না। আরগাস ফিলচ অবশ্য অনেক কিছুই জানে। আমি এখানে এসেছিলাম ছাত্র হিসাবে, আর সেটা তোমার বাবার জন্মের অনেক আগের কথা।’

     জেমস জানে ওকে সাবধানে কথা বলতে হবে। ‘হ্যাঁ সেটা আমিও ভাবছিলাম। আচ্ছা হ্যাগ্রিড কেউ যদি একটা বিশেষভাব জাদুক্ষমতা যুক্ত কিছু এই দূর্গের কোথাও লুকাতে চায় …’

     হ্যাগ্রিড ট্রাইফের গায়ে হাত বোলানো থামাল। জেমসের দিকে নিজের বিরাট মাথাটা ঘোরাল। ‘আমি কী জানতে পারি, তোমার মতো একজন প্রথম বর্ষের ছাত্রের আবার কী লুকিয়ে রাখার দরকার পড়ল?’

     ‘আরে এটা আমার ব্যাপার নয় হ্যাগ্রিড,’ জেমস তাড়াতাড়ি করে বলল। ‘আমি অন্য কারও কথা বলছি। কৌতূহল বলতে পারো।’

     র‍্যালফ বড় মাপের একটা চুমুক দিল চায়ে। জেমস জানলার বাইরের দিকে তাকাল, চাইছে না হ্যাগ্রিডের অন্তর্ভেদী চোখের দিকে তাকাতে। ‘আরে বাবা তেমন কিছু না। আমি এমনিই জানতে চাইছিলাম…’

     ‘ওহ,’ হ্যাগ্রিড একটু হেসে মাথা নেড়ে বলল। ‘তুমি বোধহয় আমার বিষয়ে তোমার বাবা, হারমায়োনি আন্টি আর রন আঙ্কেলের কাছে থেকে অনেক গল্প শুনেছ। ওরাই বলেছে তাই না? হ্যাগ্রিড মাঝে মাঝেই সব কিছু খুলে বলে না। রহস্য জমিয়ে রাখে। খুব সত্যি কথা। আমি একটু মাথামোটা ধরনের মানুষ। সব সময় আন্দাজ করতে পারি না কোনটা বলতে হবে, আর কোনটা বলতে হবে না, তুমি নিশ্চয় ফ্লাফি নামের একটা কুকুরের গল্প শুনেছ?’ হ্যাগ্রিড কিছুক্ষণ জেমসের দিকে তাকিয়ে থাকল, তারপর একটা বড় নিঃশ্বাস ছাড়ল। ‘জেমস মাই বয়, আমি এখন অনেকটাই বুড়ো হয়ে গেছি সেইসব দিনের তুলনায়। চাবির দায়িত্বে থাকা মানুষদের বেশি কিছু জানতে নেই, কিন্তু আমরা জেনে যাই। তোমার ড্যাড আমাকে এরকম একটা কিছু হবে বলে জানিয়েছিল। নজর রাখতে বলেছিল তোমার ওপর। কারণ সে জানতে পেরে গেছে তুমি ওর ইনভিজিবিল ক্লোক আর মরাউডার ম্যাপটা নিয়ে চলে এসেছো।’

     ‘মানে?’ জেমস চমকে ঝট করে ঘুরে তাকাল, আর একটু হলে চায়ের কাপটা পড়েই যেত হাত থেকে।

     হ্যাগ্রিডের ঝোপের মতো দেখতে ভুরু জোড়া উঁচু হল। ‘ও তার মানে এবার তুমি পালাবে। আমার তোমাকে কথাটা বলার ইচ্ছে ছিল না।’ একটু চিন্তার ভঙ্গীতে তাকাল, তারপর বলে উঠল, ‘মানে বলতে চাইছি যে, হ্যারি আমাকে মোটেই বলেনি এ নিয়ে কথা না বলতে।’

     জেমস বিড়বিড় করে বলল, ‘ড্যাড জেনে গেছেন? এর মধ্যেই?’

     হ্যাগ্রিড হেসে বলল, ‘জেমস তুমি মনে হয় ভুলে গেছ তোমার বাবা অরোর বিভাগের প্রধান। গত সপ্তাহে এখানে বসেই আমাদের কথা হয়েছে। হ্যারি খুব জানতে আগ্রহী ম্যাপটা ঠিকঠাক কাজ করছে কী না। কারণ দূর্গের অনেক কিছুই তো নতুন করে বানানো হয়েছে। ওর সময় বা সুযোগ হয়ে ওঠেনি ওটাকে পরীক্ষা করার। তাহলে, কী মনে হচ্ছে? ভাগ্য সঙ্গে আছে?’

     মারলিনের পোশাক হাতানোর অভিযান করতে গিয়ে মরাউডার ম্যাপটার কথা ভুলেই গিয়েছিল। হ্যাগ্রিডকে কিছুটা লজ্জালজ্জা ভাবে জানাল, এখনও ওটা পরীক্ষা করে দেখেনি।

     হ্যাগ্রিড শুনে বলল, ‘হয়তো ভালোই হয়েছে সেটা। তুমি ওটা না বলে নিয়ে এসেছ সেটা জানতে পেরে আমার তো মনে হয় না তোমার ড্যাড খুশি হয়েছেন। আর যতটা মনে হল তোমার মাম এ ব্যাপারে কিছু জানেন না এখনও পর্যন্ত। যদি তোমার ভাগ্য ভালো হয় জানতেও পারবেন না। তবে আমার মনে হয় না হ্যারি, এই খবরটা বেশিদিন লুকিয়ে রাখতে পারবেন। আমার তো মনে হয় স্কুলচত্বরে লুকিয়ে রাখার থেকে চোরাই মালটা প্যাক করে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। কারণ সন্দেহজনক জিনিস স্কুলের মধ্যে রাখাটা ভালোর চেয়ে মন্দই বেশি করতে সক্ষম।’

     শীতল বাতাসের ঝাপ্টা সহ্য করতে করতে ওরা ফিরছিল দূর্গে, এর মধ্যেই র‍্যালফ জানতে চাইল, ‘ম্যাপটা কাজ করছে কিনা তোর ড্যাড জানতে চেয়েছেন, এর মানেটা কী? ওটায় কী কাজ হয়?’

     জেমস র‍্যালফকে বুঝিয়ে বলল মরাউডার ম্যাপ ব্যাপারটা কী। ওর মনের মধ্যে একটা দোলাচল এবং উৎকণ্ঠা, কারণ ড্যাড জেনে গেছেন জিনিস দুটো নেওয়ার ব্যাপার। ও যে ধরা পড়ে গেছে এটা তো প্রমাণিত। তার শাস্তি কেবলমাত্র হ্যাগ্রিডের কাছে উপদেশ পাওয়ার মতো হাল্কা হবে এটা আশা করেনি। একটা বড় সড় চিৎকার চ্যাঁচামেচি হবে বলেই ওর অনুমান ছিল।

     র‍্যালফের আগ্রহ ম্যাপটার বিষয়ে। ‘দুর্গের মধ্যে কে কোন জায়গায় আছে এটা সত্যিই দেখা যায়? তাহলে তো ওটা একটা দারুণ কাজের জিনিস! ওটা কীভাবে কাজ করে?’

     ‘ওটাকে চালু করার জন্য বিশেষ একটা কথা বলতে হয়। ড্যাড অনেকদিন আগে আমাকে কথাটা বলেছিল কিন্তু এই মুহূর্তে ওটা মনে করতে পারছি না। আমরা কোনও এক রাতে ওটাকে চালু করার একটা চেষ্টা করব। এই মুহূর্তে আমি ওটা নিয়ে ভাবতে চাইছি না।’

     র‍্যালফ কথাটা মেনে নিল এবং সম্মতিসূচক ভাবে মাথা নাড়াল। মূল দরজা দিয়ে ঢোকার পর ওরা চলে গেল যে যার হাউসের থাকার জায়গার দিকে।

     অনেকটাই দেরী হয়ে গেছে, করিডরে এই মুহূর্তে জেমস একা। শীতের রাত, আকাশে মেঘ। একটাও তারা নেই। হলের ভেতর জ্বলতে থাকা আলো আর জানলা ভেদ করে আসা আবছা আঁধারে ঢেকে আছে জায়গাটা। জেমস কেঁপে উঠল, কিছুটা ঠান্ডায় আর কিছুটা কোনও এক শীতল আতঙ্কের অনুভুতিতে, যে-টা ছেয়ে আছে করিডরে ঘন কুয়াশার মতো। দ্রুত হাঁটার সঙ্গে সঙ্গে ও ভাবতে শুরু করল হলগুলো এত অন্ধকার এবং ফাঁকা কেন। এতোটাও দেরী হয়নি, অথচ এখানকার শীতল নীরবতা স্তব্ধতায় মনে হচ্ছে সকাল যেন আর হবে না, হাওয়ায় একটা কেমন যেন একটা প্রাচীনতার গন্ধ। সহসাই ও বুঝতে পারল যে করিডোরে ওর যাওয়া দরকার তার বদলে অন্য কোন জায়গায় চলে এসেছে। একচক্ষু জাদুকরীর স্ট্যাচুর কাছের বাঁকটা এসে যাওয়া উচিত ছিল এতক্ষণে, যেখান থেকে বামদিকে রিসেপশন হল পেছনে রেখে সিঁড়ির দিকে যাওয়া যায়। জেমস থেমে যে পথে হেঁটে এল সেদিকটায় ঘুরে তাকাল। হলটা একই রকম দেখাচ্ছে, তবুও কেমন যেন লাগছে। মনে হচ্ছে অনেক অনেক দূরে ওটা। যে ছায়াগুলো যেখানে পড়ার কথা ছিল সেখানে পড়েনি বলেই কেন জানিনা ওর চোখ জানান দিচ্ছে। নজরে এল একটাও মশাল নেই দেওয়ালে। একটা ভুতুড়ে আলো ঝুলছে, যার থেকে বের হচ্ছে হলদেটে আলোর বিচ্ছুরণ যা বদলে যাচ্ছে রূপালী আলোয়। মিলিয়েও যাচ্ছে অতি দ্রুত চোখের পলক ফেলার আগেই।

     অস্বস্তিকর বরফ শীতল আতঙ্ক জেমসের পিঠের দিকে অনুভূত হল। এক ঝটকায় ঘুরে গেল, প্রস্তুত দৌড়ানোর জন্য। কিন্তু পা সাড়া দিল না সামনের দৃশ্য দেখার পর। করিডোর যেমনকার তেমনই আছে কিন্তু পিলারগুলো বদলে গেছে গাছের গুঁড়িতে। ওপরের কড়িবরগা বদলে গেছে ডালপালায়, যার পেছন দিকটায় দেখা যাচ্ছে অনন্ত আকাশ। মেঝেটাও ঢেকে গেছে শিকড়ের বু্নোট আর মরা শুকনো পাতায়। দেখতে দেখতে করিডোরটাও মিলিয়ে গেল সম্পূর্ণরূপে। এখন শুধুই এক অরণ্য। ঠান্ডা হাওয়া ওর পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে শনশন শব্দে, পেছন দিকে উড়ছে ওর পোশাক। একটা অদৃশ্য হাত যেন পেছন থেকে ওর চুল ধরে টানছে। জেমস চিনতে পারছে এখন সে কোথায় দাঁড়িয়ে আছে। আগেরবার গাছের পাতা গাছেই ছিল আর ঝিঁঝিঁ পোকাদের কলতান শোনা যাচ্ছিল। এ সেই লেকের ধারের জায়গা যেখানে অবস্থান লুক্কায়িত দ্বীপের। গাছগুলো শুকনো ডালপালা রগড়াচ্ছে একে অপরের সঙ্গে। ওদের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া হাওয়ার শব্দ মিলে মিশে মনে হচ্ছে জ্বরগ্রস্থ কেউ যেন স্বপ্নের মধ্যে প্রলাপ বকছে। জেমস বুঝতে পারল ও এগিয়ে যাচ্ছে ওই গাছগুলোর দিকে। ওই দিকেই জলজ ঝোপঝাড় নড়াচড়া করছে লেকের প্রান্তসীমায়। একটা বিশাল কালো অবয়ব ভেসে উঠছে আস্তে আস্তে ঢেকে দিচ্ছে দৃশ্যমান সব কিছুকে। অসহায় নিয়ন্ত্রনহীন ভাবে জেমস এগিয়ে যাচ্ছে। ওদিকে ঘন মেঘের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল চাঁদ। লুক্কায়িত দ্বীপ নিজেকে প্রকাশ করছে ধীরে ধীরে, জেমসের নিঃশ্বাস আটকে গেছে। দ্বীপটা বিস্তৃত হচ্ছে। ছদ্মবেশের আড়ালে থাকা এক গোপন প্রাসাদ আরও পরিষ্কার ভাবে নিজেকে প্রতিভাত করছে। এক দৈত্যাকার গথিক ধাঁচের প্রাসাদ। ভয়ানক সব স্ট্যাচু আর গারগয়েল দিয়ে ঘেরা। যারা রূপ পরিগ্রহ করেছে দ্বীপটির গাছপালা থেকে কোন এক অজানা উপায়ে। ড্রাগনের খোলা মুখ এখন ওর সামনে। কোনওমতে নিজেকে সামলে নিয়ে ওই সেতুতে পা রাখা আটকালো জেমস। মনে পড়ে গেল ওকে আর জ্যানকে গিলে খেতে চেয়েছিল ওটা। রুপালী চাঁদের আলোয় গেটটাকে দেখা যাচ্ছিলো অপর প্রান্তে। সঙ্গেই দেখা যাচ্ছিলো সেই লেখা।

     “যখন ঝকমকে শশীর আলোয় জগৎ করবে স্নান/ আমি খুজে পাবো লুক্কায়িত স্থান;

     যখন রাত্রি হবেনির্দিষ্ট নিঃঝুম/ ভাঙ্গবে কি তার সেই ঘুম।

     ফিরে আসবে সেই আকাঙ্খার ভোর/ না হারিয়ে একটিও পবিত্র চিহ্নডোর;          

     জীবনকে ফেলে এসে, এক নতুন জীবন/ আসছে হল অফ এল্ডারস ক্রসিং এর ক্ষণ।…”

     সহসাই গেটটা কেঁপে উঠল এবং খুলে গেল, নিঃসীম অন্ধকার হাঁ করে আছে পেছনদিকে। ভেসে এল সেই অন্ধকার থেকে একটা সুমিষ্ট কণ্ঠস্বর, সুরেলা ঘণ্টার মতো।

     ‘পবিত্র চিহ্নের রক্ষক,’ বলল সেই কন্ঠ। ‘তোমার দায়িত্ব পালন সন্তোষজনক।’

     খোলা দরজাটার পেছনের জমাট অন্ধকারটার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো জেমস, একটা আলো যেন ওখানে ক্রমশঃ বড় হচ্ছে। আলোটা একত্রিত হচ্ছে, রূপান্তরিত হচ্ছে একটা অবয়বে। জেমস চিনতে পারল অবয়বটাকে, ওটা একটা ড্রায়াড। মহিলা ট্রি স্পিরিট। আগেরবার যেটার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল সেরকম নয় যদিও। আগেরটার আলো ছিল সবুজ রঙের। এর ফ্যাকাশে নীল। সামান্য এগিয়ে এল অবয়বটা। বয়ে যাওয়া জলস্রোতের মতো ড্রায়াডটার চুল উড়ছিল। মুখে একটা স্মিত সুন্দর হাসি। বড় বড় চোখ মাঝে মাঝেই চকচক করে উঠছিল।

     আগের বারের ড্রায়াডটার মতোই স্বপ্নালু এবং মায়াচ্ছন্ন করা কন্ঠস্বরে বলে উঠল, ‘তুমি তোমার দায়িত্ব পালন করেছ। তোমার রেলিকটা পাহারা দেওয়ার আর দরকার নেই। ওটা তোমার চিন্তার বিষয় নয়। ওটা আমাদের কাছে এনে দাও। আমরা ওটার অভিভাবক। শুরু থেকেই এটাই আমাদের কাজ হিসাবে দেওয়া হয়েছিল। ওই বোঝা বহনের হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করো। রেলিকটা আমাদের কাছে দিয়ে যাও।’

     জেমস নিচের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারল নিজের অজান্তেই একপা উঠিয়ে ফেলেছে সেতুটার ওপর। ড্রাগনের মুখটা এখনও বেশ খানিকটা দূরেই আছে। মুখ তুলে তাকিয়ে দেখতে পেল ওটা খানিকটা ওপর দিকে উঠে ওকে স্বাগত জানাচ্ছে। পড়ে থাকা গাছের গুঁড়ি যেখানে চোয়ালের আকৃতি নিয়েছে সেখান থেকে একটা ক্যাঁচ করে শব্দ হল।

     ‘রেলিকটা আমাদের কাছে নিয়ে এস,’ ড্রায়াডটি আবার বলল, জেমসের দিকে দু-হাত বাড়িয়ে। যেন ওকে আলিঙ্গন করতে চায়। হাতগুলো অস্বাভাবিক রকমের বড়। সেতু পেরিয়ে এদিকে চলে আসবে বলে মনে হচ্ছে। হাতের নখগুলো এতটাই ঘন নীল যে দেখে বেগুনী মনে হচ্ছে। সেগুলোও লম্বা এবং নোংরা। জেমস একপা পিছিয়ে গেল, নেমে গেল সেতু থেকে। ড্রায়াডের চোখ বদলে গেল। আরও ঝকঝকে এবং কঠোর ভাব এখন ওখানে।

     ‘রেলিকটা আমাদের কাছে নিয়ে এস,’ আরও একবার বলল কথাটা, বদলে গেছে বলার ধরণটাও। কঠোরতার ছাপ স্পষ্ট। ‘ওটা তোমার নয়। ওর শক্তি তোমার চেয়ে বেশী। শুধু তুমি কেন, তোমাদের সবার চেয়ে বেশী। ওটা তোমাকে কাবু করে ফেলার আগে আমাদের কাছে নিয়ে এস। রেলিক তাদের ধ্বংস করে দেয় যাকে ওর দরকার নেই। তোমাকেও এখন আর ওর দরকার নেই। ওটা তাড়াতাড়ি আমাদের কাছে দিয়ে যাও যাতে আর কেউ ওটা ব্যবহার করতে না পারে। দিয়ে যাও ওটা, কারণ এখনও সে ক্ষমতা তোমার আছে।’

     ড্রায়াডটির লম্বা হাত এগিয়ে আসছে ক্রমশ। জেমস নিশ্চিত আর একটু এগিয়ে গেলেই ওটা ওকে স্পর্শ করবে। আর এক পা পিছাতে গিয়ে পা আটকে গেল একটা শিকড়ে, ভারসাম্য হারাল ও। ঘুরে গিয়ে হাতটা বাড়িয়ে দিল কিছু একটা ধরার জন্য এবং আছড়ে পড়ল একটা চওড়া শক্ত কিছুর ওপর। দু-হাতের চাপ দিয়ে ওটাকে ঠেলল। একটা পাথরের দেওয়াল, ওপরের খাঁজে একটা মশাল জ্বলছে। জেমস চারদিকে তাকাল। হগ ওয়ারটসের করিডোর, উষ্ণ এবং নিস্তব্ধ নির্জন আগের মতোই। আদপেই কী ও কোথাও গিয়েছিল? হয়তো না। তাকাল অন্য দিকটায়। ওই তো সেই মোড় যেখানে একচক্ষু জাদুকরীর স্ট্যাচুটা দেখা যাচ্ছে। অস্বস্তিকর ওই পরিবেশ কোথায় যেন মিলিয়ে গেছে। যদিও জেমস বুঝতে পারছে যা ও দেখলো সেটা কেবলমাত্র একটা দেখা নয়। এখনও ওই জায়গাটার হিমশীতল হাওয়া অনুভব করছে শরীরে। নিচের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেল জুতোতে লেগে আছে নদীর ধারের কাদা। গোটা শরীরটা থরথরিয়ে কেঁপে উঠল, নিজেকে ধাতস্থ করে নিয়ে ও শুরু করল দৌড় সিঁড়ির দিকে। জোড়া জোড়া ধাপ লাফিয়ে উঠে এগিয়ে চলল কমন রুমের দিকে।

     জেমস ভালোভাবেই বুঝতে পারছে কেউ চাইছে ও মারলিনের পোশাকটা দিয়ে দিক। কিন্তু সেটা ঠিক কাজ হবে কিনা ওর ধারণা নেই। ভাগ্যক্রমে সেটা এখনও জেমসের ট্রাঙ্কে জ্যাক্সনের ব্রিফকেসেই আছে। পোশাকটা একবার স্পর্শ করার পর যা অভিজ্ঞতা হয়েছে তাতে ওটা দ্বিতীয়বার ছোঁয়ার কোনও ইচ্ছে নেই জেমসের। সময় এলে ড্যাড বা অরোর ডিপার্টমেন্টের হাতে তুলে দেওয়ার জন্যই ওটাকে কেবলমাত্র ট্রাঙ্ক থেকে বার করবে। সেই সঠিক সময়টা এখনও আসেনি, কিন্তু আসবে। তাড়াতাড়ি। কিন্তু তার আগে ও মোটেই ওটাকে কোনও রহস্যময় অবয়ব বা ট্রী স্পিরিট জাতীয় কিছুর হাতে তুলে দিতে রাজি নয়। মনে মনে এই কথা বার কয়েক আউড়ে নিয়ে ও কমনরুমে ঢুকল। ঘুম পাচ্ছে। এবার শুয়ে পড়া দরকার। খানিকক্ষণ বাদে কম্বলের তলায় ঢুকে পড়ার পরেও যেন জানলার ওপার থেকে একটা ফিসফিসে কন্ঠস্বর ক্রমাগত বলে যেতে থাকল… রেলিকটা আমাদের কাছে এনে দাও… রেলিকটা আমাদের কাছে নিয়ে এস… এখনও সে ক্ষমতা তোমার আছে… কথাগুলো ওকে শীতল করে দিচ্ছিল, এক সময় ঘুমে বুজে এল ওর চোখ। স্বপ্ন দেখতে থাকল সেই জাদুকরী সুন্দর চোখদুটোর। সঙ্গেই অস্বাভাবিক লম্বা লম্বা হাত আর বেগুনি রঙের নোংরা নখগুলোর।

*********

পরের শুক্রবার হারবোলজির ক্লাসে জেমস অবাক হয়ে দেখল নেভিল লংবটম র‍্যালফের ট্রান্স ফিগার করা পীচ গাছটা ট্রান্সফিগারেশনের ক্লাস থেকে বার করে এনে গ্রীন হাউসে রেখেছেন। ওটা এখন আর বড়ো হয়ে গেছে।

     ‘এটা একটা কলা থেকে হয়েছিল, ভাবাই যায় না,’ নেভিল জেমসের কাছ থেকে নিশ্চিত হয়ে নিতে চাইলেন।

     ‘হ্যাঁ। আমি নিশ্চিত র‍্যালফ অন্য সবার থেকে বেশী অবাক হয়েছিল। ও সত্যিই একটু অন্য রকম, কিন্তু আমার মনে হয় ওর নিজের ক্ষমতা বিষয়ে কোন ধারণাই নেই। কিছু স্লিদারিন মনে করে ও রক্তসূত্রে বিশেষ জাদু ক্ষমতার অধিকারী হয়েছে। হতেও পারে। তবে যতটা জানি, ও নিজের মায়ের বিষয়ে বেশি কিছু জানে না।’

     ‘এভাবেই ভাবতে বেশিরভাগ মানুষ অভ্যস্ত,’ নেভিল নিজস্ব বাচন ভঙ্গীমায় বললেন। ‘মাগলজাত সন্তানরাও ওই তথাকথিত শুদ্ধরক্তের ছেলে মেয়েগুলোর মতোই ক্ষমতার অধিকারী হতে পারে। পুরনো ধ্যানধারণা কিছুই বদলাচ্ছে না।’

     জেমস পীচ গাছটার দিকে তাকাল। বড়োসড় গাছটা ট্রান্সফিগারেশন ক্লাসরুমের সেই টেবিলটাকে আজও জড়িয়ে ধরে নিজের শিকড় বিস্তার করে চলেছে। নেভিলের কথাগুলো ওর সঠিক বলে মনে হলেও আজও ভুলতে পারেনি সেদিন ঘটনাটা ঘটার সময়ে র‍্যালফের মুখের ভাব, যখন কলাটাকে ট্রান্সফিগার করছিল। র‍্যালফ মুখে না বললেও জেমসের মনে হয়েছিল র‍্যালফ বেশ খানিকটা ভয়ে ভয়েই থাকে নিজের ক্ষমতা নিয়ে।

     পরের দিন গ্রিফিন্ডোরদের কুইডিচ ম্যাচ স্লিদারিনদের সঙ্গে। জ্যান আর সাব্রিনা হিল্ডেগারডের সঙ্গে জেমস বসল গ্রিফিন্ডোর স্ট্যান্ডে। র‍্যালফ নিজের স্বল্পসংখ্যক স্লিদারিন বন্ধুদের নিয়ে বসল ওদের হাউসের সবুজ গ্র্যান্ডস্ট্যান্ডে। জেমস একবার চোখাচোখি করে মাথা নাড়ল। প্রত্যুত্তরে এদিক ওদিক দেখে নিয়ে, সিনিয়র স্লিদারিনরা দেখছে কিনা, র‍্যালফও সেটাই করল।

     নিচে মাঠে দুই দলের ক্যাপ্টেন হাজির হয়েছে সেন্টার লাইনের কাছে হ্যান্ডসেক করে কেব রিডক্যালির কাছ থেকে নিয়মকানুনের কথা শোনার জন্য। যদিও এসব কেবলমাত্র দেখ্নদারি। আদপেই কেউ প্রথাগুলোকে পাত্তা দেয় না। জেমস দেখল জাস্টিন কেনেলি, টাবিথা করসিকার সঙ্গে অনিচ্ছা সহকারে হাত মেলাল। এতটা উঁচু থেকেও জেমস স্পষ্টভাবেই দেখতে পেল টাবিথার মুখে সেই চিরন্তন নম্র হাসির ছোঁয়া। এরপর দুজনেই ফিরে গেল যার যার নিজের পজিশনে, মাঠে একা থাকলেন রিডকালি তার কুইডিচ ট্রাঙ্কটা সহ।

     জ্যান সঙ্গে নিয়ে আসা পপকর্ণ চিবাচ্ছিল, রান্নাঘরের এক হাউস এলফকে পটিয়ে ও এটা জোগাড় করেছে। চারদিকের উত্তেজনায় ছটফট করতে থাকা দর্শকদের দেখে নিয়ে বলল, ‘একটা দারুন ম্যাচ হতে চলেছে বলেই মনে হচ্ছে।’

     সাব্রিনা চারদিকের চিৎকার ছাপিয়ে চিৎকার করে বলল, ‘গ্রিফিন্ডোর আর স্লিদারিনের ম্যাচে সব সময় বেশী দর্শক হয়। আমার মামের সময়ে সবাই স্লিদারিনদের অপছন্দ করতো, কারণ ওদের খেলার ধরণ ছিল বদমায়েশিতে ভরা। সেসময় মাইলস ব্লেচলে ছিল ওদের ক্যাপ্টেন। থান্ডেলরা থান্ডারারস এর থেকে ওদের দলে খেলার ডাক পেয়েছিল দু-বছরের জন্য। কিন্তু বিতাড়িত হয় লীগ থেকে, ঝাড়ু নিয়ে কীসব কারচুপি করার দায়ে।’

     জ্যান জানতে চাইল, ‘কী কারচুপি করেছিল জানা যায়নি?’

     জেমস মুখ বিকৃত করে বলল, ‘পারিভাষিকভাবে বলা যায় কর্ক দ্য ব্রুম। এক ধরনের চিটিং। ঝাড়ুর তলায় মাঝখানে একটা ফুটো করে জাদুক্ষমতা সম্পন্ন কিছু ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। সেটা ড্রাগনের পাঁজরের হাড় বা বাসিলিস্কের দাঁত বা অন্য কিছু যা ঝাড়ুটাকে বিশেষ জাদুশক্তি প্রদান করে। মাইলস ওটাকে ব্যবহার করছিল রিপেলিং মন্ত্র দিয়ে এক্সপেলিয়ারমাস মন্ত্রকে জুড়ে নিয়ে বিরোধী পক্ষকে থতমত খাইয়ে দেওয়ার জন্য। যাতে ওরা কোয়াফেলটাকে ঠিকঠাক ধরতে না পারে। পাজির পাঝাড়া ছিল লোকটা।’

     মাঠের অন্যদিকে, হোরাস স্লাগহর্ন, লাল লাল গালসহ ফারের কলারওয়ালা কোট আর সঙ্গে একটা মানানসই টুপি পড়ে স্লিদারিনের ফ্ল্যাগ নাড়িয়ে নিজের হাউস টিমকে উৎসাহ প্রদান করছিলেন। ওঁর থেকে দু-ধাপ নিচে বসে র‍্যালফ দায়িত্ব পালনের মতো করে সেই একই কাজ করছিল। জেমস জানে র‍্যালফ কুইডিচ খেলা ততটা ভালোবাসে না, তা সত্বেও মন দিয়ে খেলাটা দেখার একটা চেষ্টা ও করে। জেমসের এটাও মনে হয় র‍্যালফ মোটেই নিজের দলকে পছন্দ করে না। ওর বন্ধুরা, যার মধ্যে রুফাস বারটনও আছে, উদ্দাম উচ্ছ্বাস দেখাচ্ছে।

     এবার মাঠে প্রবেশ করল গ্রিফিন্ডোর দল, আর সঙ্গে সঙ্গেই জেমসের দিকের দর্শকেরা সমর্থন সূচক চিৎকার করে উঠে দাঁড়াল। ওদের সঙ্গে জেমসও গলা মেলাল, একরাশ হাসি আর গ্রিফিন্ডোর জিতবে এই আশা নিয়ে। জেমস লাফিয়ে উঠে একটা জোরালো উচ্ছ্বাস প্রকাশ করল চেঁচিয়ে, ওদিকে ওর দল হাসি মুখে হাত নেড়ে মাঠ পরিক্রমা শুরু করেছে।

     দুটি দল শূন্যে ভেসে উঠে নিজের নিজের জায়গা নিল। পুনরায় একটা পরিচ্ছন্ন ম্যাচের কথা বলে রিডক্যালি ব্লাজারগুলো এবং স্নিচটাকে ছেড়ে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গেই কোয়াফেল ছুঁড়ে দিলেন ওপর দিকে। খেলোয়াড়রা ব্লাজার আর কোয়াফেল এর দখল নেওয়ার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ল। নোয়া আর টম স্কোয়ালাস, দুই দলের দুই স্নিকার, ধেয়ে গেল স্নিচ লক্ষ্য করে যেটা র‍্যাভেনক্ল এর ব্যানারের দিকে উড়ে গিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল।

     কিছুক্ষণের মধ্যেই দুটো দলের খেলার ধরণের পার্থক্য বোঝা গেল। গ্রিফিন্ডোর পুরো টেক্সটবুক ধাঁচে খেলছে যেখানে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে নিয়মিত যত্ন করে নেওয়া অনুশীলনের ছাপ। জাস্টিন কেনেলির নির্দেশ ভেসে আসছে মাঝে মাঝে দর্শকদের চিৎকার ছাপিয়ে। অন্যদিকে স্লিদারিনরা একঝাঁক ছটফটে মাছের মতো এদিকে ওদিকে ভেসে বেড়াচ্ছে। টাবিথা করসিকা তার ঝাড়ু থেকে কোনও নির্দেশ পাঠাচ্ছে না, তবুও একটা অদ্ভুত নাচের মতো ছন্দে মাঝে মাঝেই ওর দলের খেলোয়াড়রা চারদিকে ছড়িয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই একত্রিত ও হচ্ছে। এরমধ্যেই একবার আক্রমণ করল স্লিদারিনরা। টাবিথা একটা ব্লাজারের হাত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে কোয়াফেলটাকে কাঁধের ওপর দিয়ে পেছনে ছুঁড়ে দিল। আর সেটাকে ধরে নিল ওরই দলের আর এক খেলোয়াড় যে লম্বা হয়ে ভেসে ছিল ওর ঠিক পেছনেই। তারপর ওটাকে সোজা ঠেলে দিল গ্রিফিন্ডর এর গোলে। গ্রিফিন্ডোর কিপার ভাবতেও পারেনি যে বলটা টাবিথার কাছে আদপেও নেই। জেমস হতাশার নিঃশ্বাস ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শুনতে পেল স্লিদারিনদের উচ্ছাস। জাস্টিন কেনেলিকে দেখে মনে হচ্ছিল পারলে ও ঝাড়ু থেকে নিচে ঝাঁপ মেরে দেয়। ম্যাচ একঘণ্টা গড়ানোর পর একশো তিরিশ বনাম একশো চল্লিশ পয়েন্টে এগিয়ে গ্রিফিন্ডোর। পাঁচবার ইতিমধ্যে বদল হয়েছে এগিয়ে থাকার পরিসংখ্যান।

     ‘এরকম ম্যাচে স্নিকারদের দায়িত্ব সব চেয়ে বেশী,’ সাব্রিনা চেঁচিয়ে বলল, চোখ খেলার দিকে রেখে। ‘স্কোয়ালাস একবারে নভিস এ ব্যাপারে। কারণ গতবছর ওই দায়িত্বে ছিল নফটন। নোয়ার উচিত ওকে দেওয়ালে আটকে রাখা নিজের ঝাড়ু দিয়ে।’

     সহসাই একটা উচ্ছ্বাস শোনা গেল। জেমস দেখতে পেল নোয়া স্নিচ লক্ষ করে ধেয়ে যাচ্ছে। ওদিকে টম স্কোয়ালাস ঠান্ডা হাওয়ার কষ্ট সামলে দাঁতে দাঁত চিপে নিজের ঝাড়ুর ওপর কাত হয়ে বসে এগিয়ে যাচ্ছে নোয়াকে আটকানোর জন্য। খেলোয়াড়দের কোনও মতে কাটিয়ে কেনেলির ব্লাজার আক্রমণ থেকে ভাগ্যজোরে বেঁচে গেল। গতি যদিও দারুণ তবু জেমস নিশ্চিত স্কোয়ালাস কোনওভাবেই নোয়াকে আটকাতে পারবে না স্নিচ দখল করা থেকে। গ্রিফিন্ডোর গ্র্যান্ডস্ট্যান্ডের ওপর দিয়ে উড়ে গেল একটা সোনালী আলো, সঙ্গে সামান্য পিছনে নোয়া। যারা সামনের রোতে বসে ছিল তারা মাথা নিচু করে নোয়াকে যেতে দিল তারপর উঠে দাঁড়াল উত্তেজনায়। নোয়া একচুলের জন্য গ্র্যান্ডস্ট্যান্ডে ধাক্কা খাওয়া থেকে বেঁচে গিয়ে এগিয়ে বসেছে ঝাড়ুর সামনের দিকে, বাড়িয়ে দিয়েছে হাত। একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাসবিহীন মুহূর্ত… নোয়া এগিয়ে যাচ্ছে সোনালী বলটাকে ছোঁয়ার জন্য। দূরত্ব কমছে, কমছে। হাত কাঁপছে নোয়ার। হঠাৎ সব কিছু বদলে গেল। নোয়া পিছিয়ে এল, ভারসাম্য সামলানোর চেষ্টায়। মাঝ আকাশে ওর সামনে এখন স্লিদারিনের একটা সাময়িক মানব দেওয়াল যার নেতৃত্বে টাবিথা করসিকা। নোয়া তবুও এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল, কিন্তু ধাক্কা খেয়ে পিছিয়ে গেল। পিছলে গেল হাত ঝাড়ু থেকে। একপাশে কাত হয়ে এক হাতে ঝাড়ু ধরে ঝুলতে থাকল। চেঁচিয়ে উঠল দর্শকেরা।

     ইতিমধ্যে টাবিথা ছিটকে বেরিয়ে গেল মানব দেওয়াল ভেদ করে। কোনও এক অদৃশ্য হাত যেন ফাঁকটা তৈরি করে দিল ওর জন্য। টাবিথার ক্লোক উড়ছিল পেছন দিকে, জেমস অবাক হয়ে দেখলো তার ফলে সৃষ্টি হওয়া ছায়াতে স্নিচটা উড়ে যাচ্ছে টাবিথার পেছন পেছন। ওটা উঠছে বা নামছে সঙ্গে সঙ্গেই টাবিথাও বদলাচ্ছে নিজের চলন। যেভাবেই হোক, না দেখেই টাবিথা ওটাকে ছায়াচ্ছন্ন রেখে এগিয়ে যাচ্ছে, সুযোগ বানিয়ে দিচ্ছে যাতে টম স্কোয়ালাস ওটা ধরতে পারে। টম ব্যাপারটা লক্ষ করে উড়ে এল দ্রুত। চকিতে বেরিয়েও গেল পাশ দিয়ে। আর যাওয়ার সময় হাত বাড়িয়ে করায়ত্ত করল স্নিচের চমক। আনন্দের শব্দ সমুদ্রের গর্জনের মতো ভেসে এল স্লিদারিন গ্র্যান্ড স্ট্যান্ড থেকে। খেলা শেষ।

     নোয়া কোনওক্রমে একটা পা ঝাড়ুতে আটকে রেখে নিচে নেমে এল। ঠিক করে সোজা হতে পারছে না দেখে টেড আর কেনেলি নেমে এল ওর কাছে সাহায্য করার জন্য। চারদিকের চিৎকার চ্যাঁচামেচিতে কথা কানে না এলেও জেমস আন্দাজ করতে পারছিল কী কথা হচ্ছে ওদের মধ্যে। একটা অদ্ভুত ধরণের কিছু ঘটে গেল কিছুক্ষণ আগে, আর সেটা স্লিদারিনরা ঘটালো কোনও রকম ফাউল না করে। নিচে ঘাসের ওপর গ্রিফিন্ডোর দলের চেজার পেট্রা মরগ্যানস্টারন কেবরিড ক্যালীকে হাত পা নেড়ে টাবিথার দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে কিছু বলতে দেখা যাচ্ছিল। করসিকা এখনও ঝাড়ুতেই ভাসমান টম স্কোয়ালাসকে পাশে নিয়ে। দলের অন্যরা ওদের অভিনন্দন জানাচ্ছে। রিডক্যালি মাথা নাড়লেন, পেট্রার অভিযোগ মেনে নিতে না পারার চিহ্নস্বরূপ। গ্রিফিন্ডোরদের আর কিছু করার নেই, কারণ বেআইনি কিছু হওয়ার প্রমাণ ওরা দেখাতে পারছে না।

     ডামিয়েন ডামাস্কাস ব্রডকাস্ট এর কক্ষ থেকে বেরিয়ে জেমস, জ্যান আর সাব্রিনার কাছে এসে জানতে চাইল, ‘সব সব্বনাশের মাথায় বাড়ি মেরে কেউ কী আমায় বলবে ওটা কি ঘটল?’

     সাব্রিনা মাথা নেড়ে বলল, ‘যা ঘটলো তা নিয়ে যে কি বলব ভেবে পাচ্ছি না। তুই কি দেখেছিস যেটা আমি দেখলাম? করসিকা সমানে স্নিচটাকে ব্লক করে রেখে দিল! একবারো না ছুঁয়ে ওটার সঙ্গে উড়ে আড়াল করে রেখে দিল। যতক্ষণ না স্কোয়ালাস ওটার কাছে পৌঁছাতে পারে।’

     বাকি দর্শকদের সঙ্গে স্ট্যান্ড থেকে বের হতে হতে জ্যান জানতে চাইল, ‘এরকম করার বিরুদ্ধে কোনও নিয়ম নেই?’

     ‘যে কাজ কার্যত অসম্ভব তার বিরুদ্ধে নিয়ম বানানো যায় না,’ ডামিয়েন বলল কিছুটা উত্তর দেওয়ার ভঙ্গীতে। ‘যতক্ষণ না সিকার বাদে অন্য কোনও খেলোয়াড় স্নিচকে ছুঁচ্ছে ততক্ষণ ফাউলের প্রশ্নই নেই। আর করসিকাতো স্নিচটার দিকে তাকায়নি পর্যন্ত। এটা আমি বাজি ধরে বলতে পারি।’

     শেষ কয়েকটা ধাপ নামছে জেমস আর জ্যান, মাঠ পেরিয়ে ছুটতে ছুটতে এল র‍্যালফ। হাঁফাতে হাঁফাতে সাব্রিনা আর ড্যামিয়েনকে পেরিয়ে এল, ওদের মুড যে ভালো নেই এটা ও বুঝতে পেরেছে।

     ‘দেখলি তোরা কীরকম যেন হল?’ র‍্যালফ কোনক্রমে দম নিয়ে প্রশ্নটা করল। ওকে দেখে বোঝা যাচ্ছিল ওর উত্তেজনার পরিমান।

     ‘হ্যাঁ দেখলাম কিছু একটা,’ জেমস বলল, ‘যদিও এখনও পর্যন্ত আমার দেখাটা ঠিক বিশ্বাস করতে পারছি না।’

     জ্যান সোজাসুজি বলল, ‘গ্রিফিন্ডোররা ভাবছে তোদের দল কিছু একটা চিটিং করেছে। এর ফলে ফাইনাল খেলা কাদের মধ্যে হবে সেটাও ঠিক হয়ে গেল। খেতাবের জন্য লড়াইটা র‍্যাভেনক্লের সঙ্গে স্লিদারিনদের হবে। আমি অবশ্য আশা করেছিলাম গ্রিফিন্ডোর বনাম র‍্যাভেনক্ল খেলা।’

     গ্র্যান্ডস্ট্যান্ডের একেবারে নিচে র‍্যালফ ঘুরে দাঁড়াল বাকি দুই বন্ধুর দিকে মুখ করে। বলল, ‘দয়া করে কুইডিচ টুর্নামেন্ট নিয়ে কথা বলাটা থামাবি তোরা এক মিনিটের জন্য? তোরা হয়তো ভুলে গেছিস, আমাদের আর দরকারি কিছু ব্যাপার নিয়ে ভাবতে হবে।’

     ‘ও তাই বুঝি! তা সেটা কী বলে ফেলো তো র‍্যালফি?’ জেমস বলল, বিরক্ত না হওয়ার চেষ্টা করতে করতে।

     র‍্যালফ একটা বড় করে শ্বাস নিল। ‘তুই আমায় বলেছিলি আমি হচ্ছি তোদের পক্ষের একজন যে ওদের দলে ঢুকে আছি, কি বলেছিলি তো? যাতে করে আমি খুব কাছ থেকে সম্ভাব্য সবরকম বিষয়ে নজর রাখতে পারি কে বা কারা মারলিন ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। ঠিক বলছি তো?’

     জ্যান ভুরু কুঁচকে বলল, ‘তোর কি মনে হয় এটা উপযুক্ত সময় ওই ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করার জন্য?’

     জেমস বলে উঠল, ‘না, না ঠিকই আছে। র‍্যালফ তুই কি কিছু দেখেছিস? স্লিদারিনদের ডেরায় কি কিছু ঘটেছে?’

     ‘নারে বাবা!’ র‍্যালফ বলল অস্থিরভাবে। ‘কমনরুম বা অন্য কোথাও কিছু ঘটেনি। এখানেই ঘটে গেল কয়েক মিনিট আগে! মনে করে দ্যাখ, আমরা কী খুঁজে পেতে চেয়েছি?’

     ‘আরে,’ জ্যান বলে উঠল, উৎসাহের স্বরে, ‘মারলিনের জাদুলাঠি।’

     র‍্যালফ সম্মতিসূচক মাথা ঝোঁকাল। কাছেই একটা উল্লাসধ্বনি শোনা গেল। তিন বন্ধু ঘুরে তাকিয়ে দেখল স্লিদারিন দল মাঠ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে, সবুজ স্কার্ফপরা ছাত্রছাত্রীর দল ঘিরে আছে ওদের। ঝাড়ু কাঁধে জয়োদ্ধত ভঙ্গীমায় টাবিথা সবার সামনে।

     ‘ছয় ফুট বা তার কাছাকাছি লম্বা, বানানো হয়েছে জাদু সম্পন্ন গাছের গুঁড়ি থেকে,’ র‍্যালফ বলল টাবিথার হেঁটে যাওয়া দেখতে দেখতে নিচু স্বরে। ‘কোথা থেকে এল কেউ জানে না।’

     ‘একদম ঠিক বলেছিস!’ জেমস বলে উঠল, র‍্যালফ কী বলছে বুঝতে পেরে। ‘টাবিথা বলে ওর ঝাড়ুটা বিশেষভাবে বানানো, কোনও এক মাগলশিল্পী নাকি ওটা বানিয়ে দিয়েছে! ও ওটাকে মাগল শিল্পকর্ম রুপে রেজিস্টারও করিয়েছে। যেহেতু ওটা ঠিকঠাক মাপসম্মত ঝাড়ু নয়!’

     ‘আর এতে কোনও প্রশ্নই নেই যে ওটায় বিশেষ অদ্ভুত রকমের জাদু ক্ষমতা আছে,’ র‍্যালফ বলল। জেমস সম্মতির ভঙ্গীতে মাথা নাড়ল।

     ‘তুই যে কথাগুলো বলছিস আমিও সেগুলো ভাবছি নাকি রে?’ জ্যান একটু থতমতভাবে বলল।

     ‘র‍্যালফ তাকাল জ্যানের দিকে। ‘কী? আমার কথাগুলোয় দম আছে তাহলে? এটাই তো নিখুঁত লুকিয়ে রাখার জায়গা! আর এইজন্যই আমি খেলা শেষ হতেই অতটা দৌড়ে এখানে এলাম। আমি চাইছিলাম তোরা দুজনেই ব্যাপারটা দ্যাখ এবং মিলিয়ে নে।’

     জ্যান সিটি মেরে বলল, ‘ওয়াও কেয়া বাত, জেমস তুই কিছুক্ষণ আগে ঝাড়ুতে কারচুপির গল্প শোনাচ্ছিলি! আর এদিকে করসিকা মারলিনের জাদুলাঠিকেই ঝাড়ু বানিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে!’

     জেমস একভাবে দেখে যাচ্ছে করসিকার হেঁটে যাওয়া দুর্গের দিকে। শীতকালীন সূর্যের আলো পড়ে ঝাড়ুটার লেজ চকচক করছে। সত্যিই একটা আদর্শ ভাবনা ছয় ফুট লম্বা অতি জাদুক্ষমতা সম্পন্ন কাঠের টুকরোকে লুকিয়ে রাখার জন্য। এখন ওরা জানতে পারল মারলিন ছকের তৃতীয় ষড়যন্ত্রকারী আসলে কে, যে অ্যাস্ট্রামাড্ডুক্স এর নামে প্রোফাইল বানিয়েছিল। জেমস হৃৎপিণ্ড লাফাচ্ছিল উত্তেজনা এবং অনুমানের আতিশয্যে।

     একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে ওরা স্লিদারিনদের পেছন পেছন এগিয়ে চলল দুর্গের পথে। ‘তাহলে,’ জেমস বলল, ‘আমরা মারলিনের জাদুলাঠিটা হাতাবো কী করে করসিকার কাছ থেকে?’

 

[চলবে]

লেখক পরিচিতিঃ  জর্জ নরম্যান লিপার্ট আমেরিকান লেখক এবং কম্পিউটার অ্যানিমেটর। তবে ওনার বর্তমান পরিচয় উনি জেমস পটার সিরিজের লেখক। যে কারনে ওনাকে “আমেরিকান রাউলিং” নামেও ডাকা হয়ে থাকে। এই সিরিজের প্রথম লেখা “জেমস পটার অ্যান্ড দ্য হল অফ এল্ডারস ক্রসিং” প্রকাশিত হয় ২০০৭ সালে। নানান কারনে এটি অনেক বিতর্কে জড়িয়ে যায়। সেসব সমস্যা পেরিয়ে আজ এটি পাঠক পাঠিকাদের চাহিদায় সারা বিশ্বে যথেষ্ট জনপ্রিয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য এই সিরিজের সব কটি বই ই-বুক এবং ফ্রি হিসাবেই প্রকাশ করেছেন মাননীয় জর্জ নরম্যান লিপারট। এই সিরিজ ছাড়াও ওনার আরো ১২ টি বই আছে। বর্তমানে উনি এরি, পেনসিল্ভ্যানিয়ার বাসিন্দা।

অনুবাদকের পরিচিতিঃ উপন্যাসটির অনুবাদক প্রতিম দাস মূলত চিত্র শিল্পী, ২০১৩ সাল থেকে ভারতের সমস্ত পাখি আঁকার লক্ষ্য নিয়ে কাজ চলছেন। ৭৭৫+ প্রজাতির ছবি আঁকা সম্পূর্ণ হয়েছে। তবে শুধু পাখি নয় অন্যান্য বিষয়েও ছবি আঁকা চলে একইসঙ্গে। দারুণ রকমের পাঠক, যা পান তাই পড়েন ধরনের। প্রিয় বিষয় রূপকথা, ফ্যান্টাসী, সায়েন্স ফিকশন, অলৌকিক। টুকটাক গল্প লেখার সঙ্গে আছে অনুবাদের শখ। 

Tags: জর্জ নরম্যান লিপারট, জেমস পটার অ্যান্ড দ্য হল অফ এল্ডারস ক্রসিং, ধারাবাহিক উপন্যাস, প্রতিম দাস, সুদীপ দেব

One thought on “জেমস পটার অ্যান্ড দ্য হল অফ এল্ডারস ক্রসিং – পার্ট ১৩

  • Looking forward for the next part,, awesome story

    Reply

Leave a Reply

Connect with

Your email address will not be published.

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!
Verified by MonsterInsights