আশারদের বাড়ি ২
রে ব্র্যাডবেরি, বাংলা অনুবাদ: যশোধরা রায়চৌধুরী
অলংকরণ:জটায়ু
বিবর্ণ, অন্ধকারাচ্ছন্ন, চুপচাপ একটা হেমন্তদিন। গোটা দিন জুড়ে আমি ঘোড়ায় চেপে একলা চলেছিলাম। আকাশের মেঘেরা চাপ চাপ মনখারাপের মতো নেমে এসেছে নীচেটায়। একটা অসম্ভব ঊষর অজ-পাড়াগাঁ দিয়ে চলেছি। যখন শেষমেশ সন্ধের ছায়া নেমে আসছে, আমার দৃষ্টিপথে গোচর হল বিষণ্ণ ‘আশারদের বাড়ি’টা।…”
মিস্টার স্তঁদেল উদ্ধৃতি দিতে দিতে থামলেন।
কালচে নীচু একটা পাহাড়ের ওপরে বাড়িটা দাঁড়িয়ে। ভিত্তিপ্রস্তরে লেখা আছে ২০০৫ অ্যানো ডোমিনি।
স্থপতি মিস্টার বিগলো বললেন, “এই নিন স্যার আপনার সম্পত্তি। একদম তৈরি। এই যে চাবিটা হস্তান্তর করলাম, মিস্টার স্তঁদেল।”
দুটি মানুষ নীরবে এই শান্ত হেমন্ত বিকেলে দাঁড়িয়ে আছেন। পায়ের কাছে খড়মড় করছে ঘাসের ওপর পড়ে থাকা ব্লুপ্রিন্টগুলো।
“আশারদের বাড়ি!” সহর্ষে বললেন মি স্তঁদেল, “পরিকল্পনা, নির্মাণ, কাগজপত্র তৈরি, অর্থকরী লেনদেন সব সমাপ্ত। আহা মিস্টার পো কী আনন্দই না পেতেন এটা দেখলে।”
“আপনি যা যা চেয়েছিলেন সব হয়েছে তো, স্যার?”
“হ্যাঁ।”
“রংটা ঠিক আছে তো? মনমরা, ভীতিকর?”
“খুব মনমরা, দারুণ ভীতিকর।”
“দেওয়ালগুলো— ম্যাড়মেড়ে— হয়েছে তো?”
“দারুণ আশ্চর্যভাবেই!”
“জলাটা? বিশ্রি কুচকুচে মসৃণ কালো?”
“অবিশ্বাস্যরকম জঘন্য মসৃণ।”
“হোগলার বনটা? আমরা রং করে দিয়েছি। ধূসর কালচে রংটা ঠিক এসেছে তো?”
“কুৎসিত, একদম!”
বিগলো তাঁর স্থপতির প্ল্যান দেখলেন। তারপর কিছুটা পড়ে পড়ে বললেন, “পুরো গঠনটা দেখে ‘হিমভাব, হাড় অবদি জমে যাওয়া, বুক শুকিয়ে যাওয়া’ এসব হচ্ছে তো? বাড়ি-হ্রদ-জমিজঙ্গল— মি স্তঁদেল?”
“মিস্টার বিগলো, আমার প্রতিটা আধুলিই উশুল হয়ে গেছে। কী সুন্দর যে হয়েছে।”
“ধন্যবাদ। আমাকে খুব গোপনে কাজটা করতে হয়েছে। আপনার ভাগ্যিস প্রাইভেট রকেট ছিল, নইলে অধিকাংশ যন্ত্রপাতিই আনতে পারতাম না। লক্ষ করেছেন এখানে সর্বদা গোধূলির আলো সেট করা আছে? এইখানে সর্বদা অক্টোবর, ঊষরতার কাল। শুনশান মৃত দুনিয়া। সেটা করতে যা খাটনি গেছে না! সব প্রাণের চিহ্ন মেরে ফেলতে হয়েছে। দশ হাজার টন ডিডিটি লেগেছে। কোন সাপ-ব্যাং, মঙ্গলগ্রহের একটা মাছিও আর বেঁচে নেই। সর্বদা এখন মরা বিকেলের আলো, মি স্তঁদেল! আমি গর্বিত! লুকোনো সব যন্ত্রপাতি দিয়ে সূর্যের আলোকে মেরে দিয়ে এই এফেক্ট আনা হয়েছে, তাই সর্বদা এখানে একদম সঠিক অর্থে এই ‘মনমরা’ আলোটাই থাকবে।”
মনমরা ভাবটা স্তঁদেল যেন চেটে চেটে খেলেন। দমচাপা ভাবটা, ভ্যাপসা গ্যাস উঠে আসা জলার থেকে। মানে গোটা পরিবেশটাই। সবটাই সূক্ষ্মভাবে তৈরি করা, বানানো। আর ওই বাড়িটা। ওই অর্ধভগ্ন বীভৎসতা। কালো জলাটা যেন কু-ডাক ডাকছে। শ্যাওলা, অনেকটা জুড়ে থাকা এক ধ্বংসের আবহ। প্লাস্টিকে তৈরি না কীসে তৈরি, কে দেখতে যাচ্ছে এখন!
হেমন্ত আকাশের দিকে তাকালেন উনি। অনেক ওপরে, দূরে, আড়ালে, সূর্য আছে কোথাও। কোথাও, মঙ্গলগ্রহের এপ্রিল মাসটা হলুদ, আকাশটা নীল। কোথাও অনেক ওপরে একটা সুন্দর মৃত গ্রহকে সভ্যতার আলো দেখাতে চেষ্টা করে, রকেটগুলো ওদের তীক্ষ্ণ আওয়াজে গর্জন করে করে ঘুরে চলেছে। আর এখানে সেই ঘুরপাকের আওয়াজকে চাপা দিয়ে দিয়েছে এই সাউন্ড প্রুফ করা আলো মরে আসা বানানো জগৎ। এই সুপ্রাচীন হেমন্তের বিশ্ব!
“আমার কাজ তো শেষ হল, এবার কি আমি জিজ্ঞাসা করতে পারি, যে, এই সম্পত্তি নিয়ে আপনি ঠিক কী করতে চান?” একটু অস্বস্তি নিয়ে বললেন বিগলো।
“আশারের বাড়ি নিয়ে? বোঝেননি নাকি? এই আশার নামটা আপনার কাছে কোনও মানে বহন করে আনে না?”
“না তো।”
“বেশ… তা হলে এই নামটা… এডগার অ্যালান পো?”
বিগলো মাথা নাড়লেন।
“বটেই তো!” স্তঁদেল সূক্ষ্মভাবে নাকের মধ্যে একটা শব্দ করলেন। বেদনা আর তাচ্ছিল্য দুই-ই তার মধ্যে মিশে ছিল। “আপনি যে বেচারা পো সায়েবের নাম জানবেন, এটা আশা করাই আমার ভুল হয়েছিল। অনেকদিন আগে মারা গেছেন। সেই লিংকনের আগে। ‘মহাযজ্ঞে’র আগুনে তাঁর সব বই পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। তাও তো হয়ে গেল বছর ত্রিশেক। সেই ১৯৭৫।”
মি বিগলো বিজ্ঞ ভাব করে বললেন, “ওহো, ওই তাঁদেরই একজন।”
“হ্যাঁ, তাঁদেরই একজন বিগলো সাহেব! উনি, লাভক্র্যাফট, হথর্ন, অ্যামব্রোজ বিয়ারস, সমস্ত ভয়ের গল্প, ভূতের গল্প, অতিপ্রাকৃত আর কল্পগল্প, আর হ্যাঁ, ভবিষ্যৎ নিয়ে লেখা গল্পও। পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল সেই আগুনে। নিষ্ঠুরভাবে। ওরা একটা আইন পাস করল। হ্যাঁ, প্রথমে বেশ ছোট করেই শুরু হয়েছিল। ১৯৫০ আর ৬০-এর দশকে এটা ছিল একটা বীজের আকারে। কার্টুনের বইগুলো প্রথমে নিষিদ্ধ করা হল, তারপর ডিটেকটিভ গল্প, আর হ্যাঁ, অবশ্যই ফিলম। এই দল ওই দল, এই রাজনীতির লোক, ওই ধর্মীয় গোষ্ঠী, সংগঠন আর ইউনিয়ন, তাদের নানা চাপ, সর্বদা কোনও না কোনও সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর আপত্তি, তাদের কোনও এক ভয়ের কথা বলত তারা— তারপর সংখ্যাগুরুরা, বাকিরাও একে একে— যারা অন্ধকারকে ভয় পেত, ভবিষ্যৎকে ভয় পেত, বর্তমানকে ভয় পেত নিজেদের ভয় পেত, নিজেদের ছায়াকেও ভয় পেত। তারপর ওরা রাজনীতি শব্দটাকেই ভয়ে পেতে আরম্ভ করল। যেটা আবার প্রতিক্রিয়াশীলদের কাছে সাম্যবাদের সমর্থক হয়ে দাঁড়াল। শুনেছি একবার শব্দটা ব্যবহার করলেই জীবন ধন্য হত একদা। তা, ক্রমশ এখানে স্ক্রু টাইট করতে হল, ওখানে নাটবল্টু, ধীরে ধীরে শিল্প সাহিত্য হয়ে দাঁড়াল একটা জবড়ঘন্ট পাকানো অদ্ভুত জিনিস। এখানে গিঁট, ওখানে বাঁধা, সেখানে টাইট দেওয়া, বিনুনিতে আটকানো। কোথাও কোনও নমনীয়তা নেই, আর স্বাদ বলতেই কিছু অবশিষ্ট রইল না। তারপর ফিল্মের ক্যামেরাগুলোর ঘড়ঘড়ানি থেমে গেল। থিয়েটারগুলোও অন্ধকার হয়ে গেল। ছাপাখানাগুলো অনেক অনেক বই গল্প উপন্যাস ঝর্নাধারার মতো ছাপছিল। সেগুলো ছাপতে লাগল সামান্য কয়েকটি ‘বিশুদ্ধ’ বিষয়। তখন ‘পালানো’ শব্দটাও বৈপ্লবিক হয়ে উঠেছিল। জানেন তো?”
“তা-ই?”
“হ্যাঁ। প্রত্যেককে তখন ‘সত্যের মুখোমুখি হতে হবে’। সবাইকে ‘এখানে’ আর ‘এখন’ এই দুইয়ের মুখোমুখি হতে হবে। যা-কিছু এই দুই নিয়ে নয়, তাদের বিদায় নিতে হবে। সব সাহিত্য যেখানে মিথ্যের সৌন্দর্য, কল্পনার উড়ান… মাঝ আকাশে গুলি করে তাদের নামাতে হবে। তাই লাইব্রেরির দেওয়ালে তাদের টাঙিয়ে দিয়ে, ১৯৭৫-এ, মানে ত্রিশ বছর আগের একটি রবিবারের সকালে— লাইন দিয়ে রেখে— সেন্ট নিকোলাস, মুণ্ডহীন ঘোড়সওয়ার, স্নো ওয়াইট, রাম্পেলস্টিল্টস্কিন, মাদার গুজ— ওহ সে কী ভয়াবহ ব্যাপার— সবাইকে গুলি করে দেওয়া হল। কাগজের দুর্গ, রূপকথার ব্যাঙামামা, প্রাচীন রাজারা, আর বাকি যতজন ‘চিরদিনের জন্য সুখে-শান্তিতে থাকবে’ বলে কথা ছিল, সব্বাইকে পুড়িয়ে দিল ওরা। কারণ এটা তো বাস্তব যে চিরদিন কেউ সুখে শান্তিতে থাকে না। আর ওই ‘অনেক অনেকদিন আগে’ ও হয়ে গেল অদৃশ্য। আর তারপর ফ্যান্টম রিকশা-র ছাই দিয়ে যাদুকর ওজের ভাঙা প্রাসাদের গুঁড়ো ঢেকে দেওয়া হল। ওজমা ও লিন্ডা দ্য গুজের মাংস ফালি ফালি করে ফেলা হল। পলিক্রোমকে ভেঙে ফেলা হল স্পেকট্রোস্কোপে পুরে। জীববিজ্ঞানীদের দপ্তরে গেল জ্যাম পাম্পকিনহেডের মৃতদেহ। জ্যাকের বরবটিগাছ লালফিতের ফাঁসে মারা পড়ল। স্লিপিং বিউটি জেগে উঠল বিজ্ঞানীর চুম্বনে আর মারা পড়ল তারই সিরিঞ্জের খোঁচায়। অ্যালিসকে এমন এক বোতলের তরল খাওয়ানো হল যে, সে ‘আশ্চর্য আর আশ্চর্যতর!’ বলার মতো অবস্থায় আর রইলই না। অ্যালিসের লুকিং গ্লাসে এমন হাতুড়ির ঘা পড়ল যে, তা চুরচুর হয়ে গেল। লাল রাজা আর ঝিনুক পালাল দূরে।”
মুঠি পাকালেন স্তঁদেল। ‘হে ঈশ্বর— কী যে দ্রুত সব ঘটে গেল!” মুখ লাল হয়ে উঠল তাঁর। হঠাৎ যেন শ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে চাইল।
মি বিগলো এই দীর্ঘ উচ্ছ্বাসে কেমন হতভম্ব হয়ে গেছিলেন। চোখ পিটপিট করে শেষমেশ বললেন, “দুঃখিত, আপনি এতক্ষণ ধরে কী যে বলে গেলেন বিন্দুবিসর্গ বুঝতে পারিনি। কয়েকটা নামের তালিকা, এটা ধরা গেল শুধু। আমি যা শুনেছি, মহাযজ্ঞের আগুনটা মানবসভ্যতার শুভসূচক এক ঘটনাই ছিল। যা ঘটেছিল সব ভালোর জন্যই। “
“বেরিয়ে যান!” চিৎকার করলেন স্তঁদেল, “আপনার কাজ আপনি করে দিয়েছেন, এবার আমাকে একা থাকতে দিন। মূর্খ কোথাকার!”
বিগলো নিজের মিস্ত্রিদের ডেকে নিয়ে চলে গেলেন। স্তঁদেল একা দাঁড়িয়ে রইলেন তাঁর বিশাল বাড়ির সামনে। অদেখা রকেটগুলোকে তিনি বললেন, “শোনো হে! তোমাদের সব ‘স্পষ্ট চিন্তা করা’ মানুষদের এড়াব বলেই আমি মঙ্গলগ্রহে এসেছিলাম, কিন্তু তোমরা আবার ভিড় জমাচ্ছ এখানে— যেভাবে মাছিরা পচা নাড়িভুঁড়ির লোভে আসে। আমি তোমাদের দেখাব মজা। পো সায়েবকে পৃথিবীতে যেমন করেছ তোমরা, আমিও তোমাদের তেমনি শিক্ষা দেব। আজকের মতো সাবধান করলাম। আজ থেকে ‘আশারদের বাড়ি’ ব্যাবসার জন্য উন্মুক্ত!”
আকাশের দিকে মুঠো পাকিয়ে ছুড়ে দিলেন স্তঁদেল।
একটা রকেট নামল। একটি লোক ইতস্তত করে নামল তা থেকে। তার ধূসর চোখে অসন্তোষ আর সংশয়। সে জলাটার পাশ দিয়ে হেঁটে এসে ছোটখাটো মানুষটির সামনে দাঁড়ল।
“আপনার নাম স্তঁদেল?”
“হ্যাঁ।”
“আমি গ্যারেট। নৈতিক জলবায়ুর পরিদর্শক ও তদন্তকারী।”
“ও! তা হলে নৈতিক জলবায়ুওয়ালারা শেষমেশ মঙ্গলগ্রহ অব্দি পৌঁছে গেছে!”
“আমরা এসে গেছি গত সপ্তাহেই। পৃথিবীর মতোই এখানেও সবকিছুকে পরিচ্ছন্ন ও বিশুদ্ধ করতে পারব অতি দ্রুত, এটাই আমাদের উদ্দেশ্য।”
লোকটা একটা আইকার্ড ঝাঁকিয়ে সামনের বাড়িটার দিকে হাত তুলে দেখাল।
“স্তঁদেল, এই জায়গাটা সম্বন্ধে আরেকটু বলবেন কি?”
“এটা হল গিয়ে একটা ভূতুড়ে দুর্গ। বুঝলেন তো?”
“না বুঝলাম না। একদমই ভালো লাগল না ওই ‘ভূতুড়ে’ শব্দটা।”
“কেন, সহজ শব্দ তো। আমাদের এই ২০০৫ খ্রিস্টাব্দে আমি একটি যান্ত্রিক উপায়ে তৈরি শান্তির আলয় বানিয়েছি। এখানে তামার বাদুড়েরা ইলেকট্রনিক কারিকুরিতে উড়ে বেড়ায়, পিতলের ইঁদুরেরা প্লাস্টিকের ভাঁড়ার ঘরে দৌড়য়, রোবট কঙ্কালেরা নাচে, রোবট ভ্যাম্পায়াররা, হার্লেকুইনেরা, নেকড়ে শেয়াল শকুনেরা ঘোরে। সাদা ভূতেরা— রাসায়নিক উদ্ভাবনে তৈরি ধোঁয়াটে ভূতেরা— এখানে বাস করে।”
গ্যারেট শান্তভাবে হেসে বললেন, “এটাই ভয় পাচ্ছিলাম। দুঃখিত, কিন্তু আপনার এই আশ্রয়টি ধ্বংস করে ফেলা ছাড়া আমাদের কোনও উপায় নেই।”
“জানতাম আপনারা আসবেনই। যেই জানতে পারবেন কী করছি …”
“আমরা আরও আগেই আসতাম। তবে নৈতিক জলবায়ুর এই আমরা আপনার উদ্দেশ্য সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ হতে চাইছিলাম আগে।”
“আপাতত, আমাদের ধ্বংসবিশারদ আর অগ্নিসংযোগকারী সেবকদের ডেকে পাঠান হয়েছে। মধ্যরাত্রির মধ্যে আপনার এই পুরো জায়গাটাকে একদম মাটির নীচের ভাঁড়ার অব্দি মিশিয়ে দেওয়া হবে। মি স্তঁদেল, আমার মতে আপনি একজন মূর্খ। এত কষ্টার্জিত অর্থ একটা পাগলামোর পেছনে লাগিয়ে দিলেন। এ বাড়ির পেছনে তো আপনার বেশ খরচ হয়েছে মনে হয়। ত্রিশ লক্ষ ডলার তো বটেই।”
“চল্লিশ লক্ষ ডলার মি. গ্যারেট। আমি খুব অল্প বয়সে দু-কোটি টাকার মালিক হয়েছিলাম। তাই যা খুশি করে টাকা খরচ করতেই পারি। যদিও খুবই আপসোসের ব্যাপার হবে যদি এক ঘণ্টা আগে যে-বাড়িটা তৈরি করা শেষ হল সেটাকে আপনারা, মানে ওই আপনাদের কী বলে যেন, ধ্বংসবিশারদ সেবকরা এসে ভেঙে দেয়। হুড়োহুড়ি কেন করছেন গ্যারেট সায়েব। আমাকে আমার খেলনাটা নিয়ে অন্তত চব্বিশ ঘণ্টা একটু খেলা করে নিতে দিন-না দয়া করে।”
“আইন তো আপনি জানেন। অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে হবে সেটা। কোনও বই, কোনও বাড়ি, ভূতটুতের, ভাম্পায়ারদের, পরিদের বা কোনও কাল্পনিক প্রাণীদের কথা মনে আনে, এমন কোনও কিছুকেই বরদাস্ত করা যাবে না। তৈরি করা যাবে না।
“ক-দিন পরে তো আপনারা ব্যাবিটদেরও পুড়িয়ে দেবেন দেখছি!”
“মি স্তঁদেল, আপনি আগেও প্রচুর সমস্যা সৃষ্টি করেছিলেন, এই তো রেকর্ডে দেখতে পাচ্ছি। কুড়ি বছর আগে। পৃথিবীর বুকে। আপনি আর আপনার লাইব্রেরি।”
“হ্যাঁ আমি ও আমার লাইব্রেরি। আর আমার মতো কয়েকজন, অল্প ক-জন। আহা, পো সাহেবকে ভুলে গেছে সবাই কত দিন হল। আর ওজ-কে। আর অন্য সব কাল্পনিক প্রাণীদেরও।
তবে আমার নিজের ছোট্ট সংগ্রহ ছিল। আমাদের নিজেদের লাইব্রেরি ছিল। আমরা নিজস্ব সংগ্রহ বাঁচিয়ে রেখেছিলাম। যতদিন না আপনারা লোক পাঠিয়ে মশাল দিয়ে জ্বেলে, দাহযন্ত্রের ভেতরে পুরে, ছিঁড়েখুঁড়ে আমার পঞ্চাশ হাজার বইকে ধ্বংস করে দিলেন। যেমন হ্যালোয়িন-এর বুকে বল্লমের খোঁচা দিয়েছেন। চলচ্চিত্র নির্মাতাদের বলেছেন কিছু বানালে তারা আর্নেস্ট হেমিংওয়ের গল্প নিয়ে চলচ্চিত্র বানাক। ফর হুম দ্য এল টোলস অন্তত ত্রিশটা আলাদা আলাদা চলচ্চিত্র হয়েছে। কতবার আর এক জিনিস বানাবে লোকে, সব বাস্তবধর্মী, সব একেবারে ‘এখন’ আর ‘এখানে’ দিয়ে তৈরি। নিকুচি করেছে এসবের।”
“তিক্ততা পয়দা করে লাভ নেই কিছু।”
“তা মি. গ্যারেট, আপনাকে তো একটা বড় করে রিপোর্ট লিখতে হবে, তা-ই না?”
“হ্যাঁ।”
“তো আপনার কৌতূহল হচ্ছে না দেখতে, যে, এ বাড়ির ভেতরটা কেমন? একটু ভেতরে এসে এক-দু-মিনিটে ঘুরে দেখে যান-না, দয়া করে।”
“বেশ। আপনি আগে আগে চলুন। আর কোন চালাকি করবেন না। আমার কাছে বন্দুক আছে।”
আশারের বাড়ির দরজাটা ক্যাঁচ করে খুলে গেল। একটা ভিজে ভিজে হাওয়া বয়ে গেল। বাড়িটা যেন দীর্ঘশ্বাস ফেলল, কাতরে উঠল। যেন একটা মাটির তলার গুমকুঠুরি থেকে উঠে আসা কাতরোক্তিপূর্ণ শ্বাস প্রশ্বাস।
পাথরের তৈরি মেঝে দিয়ে একটা ইঁদুর দৌঁড়ে গেল। গ্যারেট চিৎকার করে এক লাথি দিলেন ইঁদুরটাকে। উলটে গেল ইঁদুরটা। আর তার থেকে ধাতব তারের ঝাঁক বেরিয়ে এল নাইলনের লোম ভেদ করে। আশ্চর্য তো! গ্যারেট নীচু হয়ে দেখতে লাগলেন।
একটা কোণায় এক বৃদ্ধা ডাইনি বসে আছে, তার মোমে তৈরি হাত কাঁপছে। কমলা নীল রঙা ট্যারট কার্ড নিয়ে বসে আছে। তার মাথা ঝাঁকাল সে, আর দাঁতহীন মুখে হিস হিস করে আওয়াজ করল গ্যারেটের দিকে লক্ষ করে। পুরোনো চিটচিটে তাসগুলোতে নখ দিয়ে ঠুকে ঠুকে চিৎকার করে এল “মৃত্যু!”
“হুঁ, এই এই বিষয়গুলোকেই আমি আপত্তিকর বলছি।” গ্যারেট বললেন, “অতি জঘন্য জিনিস।”
“আচ্ছা আপনাকে নিজে নিজে বেশ মজা করে করে একে পুড়িয়ে দিতে দেব।”
গ্যারেট খুব খুশি হয়ে বললেন, “তা-ই, দেবেন?” তারপর ভুরু কুঁচকে বললেন, “বলতেই হবে, আপনি বেশ খেলোয়াড়ি মনোবৃত্তি নিয়ে ব্যাপারটা নিচ্ছেন।”
“আরে আমার তো এটাই পরিতৃপ্তির বিষয় যে আমি এই জায়গাটা বানাতে পেরেছি। অন্তত বলতে পারব, আমি করেছিলাম। আমাদের এই আধুনিক অবিশ্বাসীদের জগতে একটা মধ্যযুগীয় পরিবেশ রচনা করেছিলাম।”
“ইচ্ছে না থাকলেও মানতেই হচ্ছে আপনার সৃষ্টিশীলতা বেশ অভিনবই।” গ্যারেট একটা কুয়াশাকে ভেসে যেতে দেখলেন। ফিসফিস, ফিসফিস। তরল, আকারে এক সুন্দরী নারীর মতো বিজবিজ করে বয়ে যাওয়া একটা কুয়াশা। ভিজে স্যাঁতসেঁতে একটা সরু গলিপথের ওধার থেকে একটা যন্ত্র ঘরঘর শব্দ করে উঠল। আর তার থেকে বুড়ির চুলের মতো সাদা ধোঁয়া উঠতে লাগল। নীরব বিশাল হলঘরে ছড়িয়ে গেল বিজবিজ শব্দ করে।
কোত্থেকে যেন একটা বনমানুষ এসে উপস্থিত হল।
“আরে আরে, এ কে আবার!” গ্যারেট বললেন।
“ভয় পাবেন না, এ হল রোবো মানুষ।” স্তঁদেল জন্তুটার কালো বুকে টোকা দিলেন।
“তামার কঙ্কাল। ওই ডাইনির মতোই। দেখুন।”
বনমানুষের লোমের ওপর আঙুল রাখতেই তলা থেকে ধাতুর টিউব দেখা গেল।
“হ্যাঁ, তা-ই তো।” গ্যারেট জন্তুটিকে থাবড়ে দিলেন হাত বাড়িয়ে। “কিন্তু কেন স্তঁদেলসায়েব, কেন এত সবের আয়োজন? কী উদ্দেশ্যে আপনার এই পাগলামি?”
“মি গ্যারেট, এও এক ধরনের প্রশাসন। আমার অবশ্য এত ব্যাখ্যা করার সময় এখন নেই। সরকার বাহাদুর বুঝতে পারবেন নিশ্চয়ই ক্রমে ক্রমে।”
স্তঁদেল বনমানুষটার দিকে মাথা নাড়লেন। “হ্যাঁ এবার।”
বনমানুষটা গ্যারেটকে মেরে ফেলল।
“আমরা কি রেডি, পাইকস?”
পাইকস টেবিল থেকে মুখ তুললেন, “হ্যাঁ স্যার।”
“দুর্দান্ত কাজ হয়েছে পাইকস।”
“আমাকে তো আপনি টাকা দেনই এ-জন্য, মি স্তঁদেল।” পাইকস আলতোভাবে বললেন, তারপর রোবোটের চোখের পাতাটা তুলে তার ভেতরে কাচের অক্ষিগোলকটা লাগিয়ে দিলেন। রাবারের মতো পেশিগুলি ঠিকঠাক বসে গেল। “এই তো।”
“একদম. মি গ্যারেটের হুবহু সংস্করণ।”
“এবার ওঁকে নিয়ে কী করা?” পাটাতনের ওপরে সত্যিকারের গ্যারেটের মৃতদেহের দিকে মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন পাইকস।
“পুড়িয়ে দিন, পাইকস। দুটো মি. গ্যারেটের তো কোনও দরকার নেই, না?”
পাইকস চাকাওয়ালা গাড়িতে করে মি. গ্যারেটকে ইটে তৈরি চুল্লির কাছে নিয়ে গেলেন।
“গুড বাই।” মি গ্যারেটকে ভেতরে ঠেলে দিয়ে দরজাটা দড়াম করে বন্ধ করলেন।
স্তঁদেল গ্যারেটের রোবট এর দিকে ফিরলেন। “আপনার সব নির্দেশাবলী মুখস্ত তো মি. গ্যারেট?”
“হ্যাঁ স্যার।” রোবট উঠে বসল। “আমাকে আবার ফিরতে হবে নৈতিক জলবায়ুর দপ্তরে। আমি ভালো করে একটা রিপোর্ট দর্জ করব। আটচল্লিশ ঘণ্টার আগে কোনও অ্যাকশন না নেওয়া হয় যেন। কারণ আমি পুরোটা ভালো করে তদন্ত করে দেখতে ইচ্ছুক।”
“একদম, গ্যারেট। বিদায়।”
রোবট গ্যারেট তাঁর রকেটের দিকে দ্রুত চলে গেলেন। রকেটে উঠে প্রস্থান করলেন আকাশপথে।
স্তঁদেল ফিরলেন পাইকসের দিকে। “তা হলে পাইকস, তালিকা ধরে ধরে বাকি সব নেমন্তন্ন চিঠিগুলো পাঠিয়ে দেওয়া যাক এবার। আজ রাতেই তো পার্টি। খুব মজা হবে আজ, তা-ই না?”
“তা তো বটেই। কুড়ি বছর ধরে তো এই দিনটারই অপেক্ষায় ছিলাম।”
দুজনে পরস্পরের দিকে চোখ মটকালেন।
সন্ধে সাতটা।
ঘড়ি দেখলেন স্তঁদেল। প্রায় সময় হয়ে এসেছে।
শেরির গ্লাসটা সামান্য ঘোরালেন। চুপ করে বসে আছেন। ওপরে, ওক কাঠের কড়িবরগার ওপরে বাদুড়গুলো ঝুলছে।
তামায় তৈরি সূক্ষ্ম তাদের দেহ, বাইরে রবারের মাংসপেশি দিয়ে ঢাকা। বাদুড়গুলো স্তঁদেলের দিকে চোখ পিটপিটিয়ে চাইছে আর চিঁ চিঁ করে শব্দ করছে। তাদের দিকেই নিজের গ্লাস তুললেন স্তঁদেল। “আমাদের সাফল্যের জন্য।”
তারপর তিনি আরাম করে হেলান দিলেন, চোখ বুজলেন, আর পুরো ব্যাপারটাকে বোঝার চেষ্টা করলেন। এই পুরো ঘটনাটাই, বুড়ো বয়সে তিনি চেখে চেখে উপভোগ করবেন। জীবাণুনাশক সরকারকে ফেরত দেওয়া তাঁর এই উপহার। সাহিত্যে সন্ত্রাস আর শাস্তি প্রবর্তন করা সরকার।
ওহ, বছরের পর বছর ধরে কী ভীষণ রাগ আর কষ্ট আর হতাশা যে তাঁর মনে জমে উঠেছিল। আর এই পরিকল্পনাটা, কীরকম আস্তেধীরে তা তাঁর অবশ মনের ভেতর আকার গ্রহণ করল, তারপর এল সেইদিন তিন বছর আগে, যেদিন তাঁর পাইকস এর সঙ্গে সাক্ষাৎ হল।
হ্যাঁ পাইকস। সবুজ অ্যাসিডের কালচে, পুড়ে যাওয়া এক কুয়োর মতো তিক্ততায় ভরা পাইকস। কে ছিল এই পাইকস?
ওই ওদের মধ্যে সবচেয়ে বিশাল ব্যক্তিত্ব। যার দশ হাজার মুখ আছে, রাগের, ধোঁয়ার, নীল কুয়াশার, সাদা বৃষ্টির, বাদুড়ের, বীভৎস চেহারার জলনিকাশী নালার মুখের (গারগয়েল), রাক্ষসের…। সেটাই পাইকস। লন চেনি, পিতা, তার চেয়েও দুরন্ত ভালো পাইকস। স্মৃতিরোমন্থন করছিলেন স্তঁদেল।
রাতের পর রাত তিনি চেনি-কে কত কত প্রাচীন চলচ্চিত্রের ভেতর দেখেছেন। কিন্তু হ্যাঁ, পাইকস চেনির চেয়েও বেশি ভালো। অন্য আরেকটা কে যেন ছিল? প্রাচীন যেই অভিনেতা? কী নাম ছিল যেন তার? কারলফ? তার চেয়েও ভালো। অনেক ভালো। লুগোসি? নাহ তুলনাতেই আসে না। না, পাইকস একাই। একজনই পাইকস হতে পারে। আর তার কল্পনাশক্তিকে তার থেকে ছিঁড়ে নেওয়া হল!
পৃথিবীতে তার আর যাবার জায়গা রইল না। কারওকে সে দ্যাখনদারি করতে পারবে না। নিজের ক্ষমতার প্রদর্শনী করা বন্ধ তার। এমনকী নিজের আয়নার সামনে দাঁড়িয়েও সে অভিনয় করতে পারবে না। সেটাও নিষিদ্ধ!
বেচারি, পরাজিত, অসম্ভব কষ্ট পাওয়া পাইকস। ঠিক কীরকম লেগেছিল, পাইকস, যে রাতে তোমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হল সব ফিল্ম-এর কপিগুলো, যেন ক্যামেরা থেকে হেঁচড়ে বের করে নেওয়া হচ্ছে অন্ত্র, নাড়ীভুঁড়ি? যেন তোমার শরীর থেকে, পেট থেকেই! তারপর তাল পাকিয়ে সেগুলোকে ছুড়ে দেওয়া হচ্ছে, জটলা পাকিয়ে গোল্লা পাকিয়ে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে চুল্লিতে, পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। সেটা কি পঞ্চাশ হাজার বই পুড়িয়ে, কোন সান্ত্বনা ছাড়াই ‘নেই’ করে দেবার মতোই যন্ত্রণা ছিল?
হ্যাঁ। হ্যাঁ। স্তঁদেলের হাত দুটো আবার অবশ রাগে ঠান্ডা হয়ে এল।
ওরা দুজনে যে অসংখ্য কফির পাত্র উজাড় করে করে মধ্য রাত অব্দি জেগে কথা বলে বলে এই পরিকল্পনা ফাঁদবে, তাতে বিস্ময়ের কী আছে। সব কথা থেকে, আর সব তেতো কফির আরক থেকে, সে “আশারদের বাড়ি” নামক আষাঢ়ে গল্পটার উৎপত্তি হবে, তাতেই বা আশ্চর্য কী!
গির্জের ঘণ্টার আওয়াজ পাওয়া গেল। অতিথিরা আসতে শুরু করে দিয়েছেন।
স্মিতমুখে উনি গেলেন তাঁদের স্বাগত জানাতে।
পুরোপুরি প্রস্তুত, স্মৃতিহীন, রোবটগুলো অপেক্ষায় রইল।
সবুজ, বনানীর হ্রদের মতো সবুজ রেশমের জামা, ব্যাং ও ফার্নের মতো সবুজ জামায়, তারা অপেক্ষা করছিল। সূর্যের মতো, বালির মতো হলুদ চুলে, রোবট রা অপেক্ষা করছিল। ভালো করে তেল দেওয়া, টিউবের হাড়ে, ব্রঞ্জের তৈরি কঙ্কালে, জেলাটিনে ডুবনো অবস্থায়, রোবটেরা ছিল। কফিনের ভেতর শায়িত। না মৃত না জীবিত।
পাটাতনের বাক্সে, পেন্ডুলামেরা যেন দুলবার জন্য প্রস্তুত হয়ে শায়িত ছিল। কবে তারা চালু হবে। ঘষা পেতল আর তেল-গ্রিজের গন্ধে মাখামাখি হয়ে। কবরখানার নীরবতায়। লিঙ্গ আছে কিন্তু লিঙ্গহীন তারা, রোবটেরা। নাম আছে কিন্তু তখনও নাম ধরে ডাকেনি কেউ। মানুষের থেকে সবকিছু ধার করেছে তারা। শুধু মনুষ্যত্বটুকু ছাড়া। পেরেক দেওয়া ঢাকনার ভেতরে, বড় বড় মালবাহী বাক্সের ভেতরে, এমন মৃত্যুর ভেতরে শায়িত তারা যেটা মৃত্যুও না ঠিক। কারণ তাদের তো জীবনই ছিল না কোনও।
আর এখন, উপড়ে নেওয়া পেরেকের, চড়াৎ শব্দের আর্তনাদ ক্রমাগতই হতে লাগল। ঢাকনা খুলে যেতে লাগল একে একে।
বাক্সগুলোর ওপর কাদের যেন শরীরের দীর্ঘ ছায়া পড়তে শুরু করল। হাতের চাপে নল মুখ থেকে মেশিন অয়েল ছিটকে উঠতে লাগল।
এক একটা ঘড়ি চালু হচ্ছে, শোনা যাচ্ছে হালকা টিকটিক শব্দ। আবার একটা, ওই আরও একটা। যতক্ষণ না পুরো জায়গাটা একটা সুবিশাল ঘড়ির দোকানের মতো, টিকটিক শব্দের একটা সম্মিলিত উত্থান… বেড়ালের ঘড়ঘড়ানির মতো আওয়াজে। মার্বেলের চোখ ঘুরছে, রবারের চোখের পাতার তলায়। নাকগুলো কুঁচকোচ্ছে। রোবটেরা কেউ বনমানুষের মতো কালচে লোমে ঢাকা, কেউ-বা সাদা খরগোশের রোমে… উঠে আসছে তারা… টুইডলডাম টুইডল ডির পেছনে আসছে, আসছে মক টার্টল, ডরমাউজ, সমুদ্রের তলদেশ থেকে ডুবে যাওয়া শরীরেরা যেন, নুন মাখা, সামুদ্রিক জলদামে জড়ানো… দুলতে দুলতে তার উঠে আসছে, নীল কণ্ঠ হয়ে যাওয়া ফাঁসি যাওয়া লোক, যাদের চোখ উলটে গেছে, ভেতরের লালচে গোলাপি মাংস দেখা যাচ্ছে খোলা ঝিনুকের মতো। বরফের প্রাণী, পুড়িয়ে দেওয়া টিনের প্রাণী, ফেনার বামন, লংকার এলফ।
টিক টক, রাগেডো, সান্টাক্লস, নিজের সামনে লটকে থাকা তুষারমেঘ শুদ্ধু। অ্যাসিটিলিনের শিখার মতো গোঁফওয়ালা ব্লুবেয়ার্ড। সালফারের মেঘ, সবুজ আগুন ছাড়তে ছাড়তে আসছে, গায়ে আঁশওয়ালা বিশাল সর্পিল ড্রাগন, পেটের ভেতর চুল্লি… দরজা দিয়ে চিৎকার করে বেরিয়ে এল। খুটখুট, হাউমাউ, নীরবতা। হুড়োহুড়ি, বাতাসের ঝাপটা। দশ হাজার বাক্স থেকে ঢাকনি খুলে গেছে। ঘড়ির দোকান আশারের বাড়িতে রূপান্তরিত। রাত্রি মোহময়ী তখন।
উষ্ণ হাওয়া বয়ে গেল এ পৃথিবীতেও। কেননা অতিথিদের রকেটগুলো আকাশের আগুন বুলিয়ে এসে নীচে নামল। মুহূর্তে আবহাওয়া হেমন্ত থেকে বসন্তে রূপান্তরিত হয়ে গেল যেন। সান্ধ্য পোশাকে নামলেন পুরুষেরা, নারীরা তাদের পেছনে, নিপুণভাবে কেশসজ্জা করে।
“ওহ এটাই তা হলে আশারদের বাড়ি।”
“এ কী, দরজা কই?”
সেই মুহূর্তে স্তঁদেল এলেন। মেয়েরা হেসে উঠলেন, কলকাকলি করলেন।
হাত তুলে স্তঁদেল সবার নীরবতা প্রার্থনা করলেন। ঘুরে, তিনি দুর্গের উঁচু জানালার দিকে ফিরে বললেন, “রাপুনজেল, রাপুনজেল, তোমার চুল নামিয়ে দাও।”
ওপর থেকে এক পরমাসুন্দরী মুখ বাড়িয়ে দিল। রাত্রির বাতাসে উড়িয়ে দিল তার চুল… সোনালি চুল। ঘুরতে ঘুরতে নামল সে চুল, আর তৈরি হয়ে গেল এক দড়ির মই। প্রতিটি অতিথি হাসতে হাসতে সে সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেলেন দুর্গের ভেতরে।
কী বিশাল সব সমাজতাত্ত্বিক এঁরা। অতি চালাক সব মনস্তত্ত্ববিদ। কী ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব সব, রাজনীতিক, ব্যাকটিরিয়োলজিস্ট, স্নায়ুবিশারদ! অন্ধকার বিশাল হলঘরে দাঁড়িয়ে আছেন সবাই।
“স্বাগত! সবাইকে স্বাগত!’
মি. ট্রিয়ন, মি. ওয়েন, মি. ডান মি. ল্যাং মি. স্টেফেনস মি. ফ্লেচার ও আরও সবাই… গন্ডায় গন্ডায় পণ্ডিতেরা!
“আসুন আসুন।”
মিস ফিব মিস পোপ মিস চার্চিল মিস ব্লান্ট মিস ড্রামন্ড আরও এক কুড়ি চকচকে মহিলা।
বিখ্যাত, বিখ্যাত সব লোক। “কল্পকথা নিবারক সমিতি”র সদস্যেরা। হ্যালোইন ও রূপকথাকে নির্বাসিত করার পক্ষের প্রতিনিধিরা। বাদুড় নিধনকারী, পুস্তক দাহকর্তা, মশালবাহক, নৈতিক জলবায়ুর সেবক সব, সব্বাই। পরিচ্ছন্ন ভালো নাগরিক এঁরা প্রত্যেকে।
অপেক্ষায় ছিলেন এতদিন, কিছু বলবান লোক আগে এসে সবকটা মঙ্গলগ্রহের বাসিন্দাকে কচুকাটা করে শহরগুলোকে পরিষ্কার করে ও নগরগুলোকে বানিয়ে তুলে, রাস্তাগুলো সারিয়ে তুলে সবকিছুকে নিরাপদ করা অব্দি। সব যখন একেবারে নিরাপত্তার চাদরে মোড়া, তখন এলেন এঁরা, মজা-নিবারণ করার গোষ্ঠি। এঁদের রক্তের বদলে আছে মারকিউরোক্রোম, আর চোখের ভেতরে আছে আয়োডিনের রং।
এখন তাঁরা নৈতিক জলবায়ু স্থাপন করবেন, রাশি রাশি ‘শুভ’ বিতরণ করবেন সবাইকে। আর এরাই সব স্তঁদেলের বন্ধু ছিলেন। হ্যাঁ অতি সন্তর্পণে, সযত্নে, তিনি এদের প্রত্যেকের সঙ্গে দেখা করেছেন এবং বন্ধুত্ব করেছেন গত বছরে, পৃথিবীর বুকে।
“আসুন, এই মৃত্যু উপত্যকায় আপনাদের স্বাগত!”
“আরে, স্তঁদেলসায়েব, এসব কী!”
“দেখতেই পাবেন। সবাই নিজেদের পোশাক ছেড়ে এই কস্টিউমগুলো পরে নিন। দেখুন দু-পাশে বুথ বানানো আছে। ওখানে কস্টিউম রাখা আছে। পুরুষরা এইদিকে, মহিলারা ওইদিকে।”
সবাই অস্বস্তিতে পড়েছেন বোঝা গেল।
“আমাদের কি এখানে থাকা উচিত? আমার ঠিক ভালো বোধ হচ্ছে না ব্যাপারটা। এটা তো, ইয়ে… বিশ্বাসভঙ্গের কাছাকাছি কিছু।” মিস পোপ বললেন।
“কী সব যা তা ব্যাপার! কস্টিউম বল পার্টি!”
“ব্যাপারটার গন্ধটা সন্দেহজনক। বেআইনি বলে মনে হচ্ছে।” মি স্টিফেন নাক কুঁচকোলেন।
“আরে অতশত কী ভাবছেন। মজা করুন, মজা। কাজ এখানে ধ্বংসস্তূপ থাকবে, আর কিচ্ছু না। বুথে ঢুকে জামা পালটে আসুন।”
গোটা বাড়িটা জেগে উঠেছে। রঙিন হয়ে উঠেছে। মাথায় ঘুন্টি লাগানো গাধার টুপি পরা হার্লেকুইনরা দৌড়ে বেড়াচ্ছে টুং টুং শব্দ করে, সাদা ইঁদুরেরা নেচে চলেছে, বামনেরা বাজনা বাজাচ্ছে, ছোট ছোট বেহালায় ছোট্ট ছড় টেনে টেনে। সাদা বাদুড়েরা ছোট ছোট দলে উড়ে বেড়াচ্ছে, পতাকা উড়ছে পোড়া কড়িবরগার থেকে।
গারগয়েলগুলোর মুখ থেকে মদ ঝরে পড়ছে, শীতল আরকের মতো, উদ্দাম, ফেনিল মদ।
একটা ছোট নদীর মতো বয়ে যাচ্ছে সাতটা ঘরের মধ্যে দিয়ে, সবাই মুখোশ পরা এখন, অতিথিরা মদ তুলে নিয়ে পান করছেন। শেরি খেয়ে মাতাল হচ্ছেন তাঁরা। বুথ থেকে বেরিয়ে আসছেন অতিথিরা সবাই অন্য এক যুগের প্রতিভূ হয়ে, মুখগুলি ঢাকা মুখোশে। মুখোশ পরা মাত্র যেন তাঁদের কল্পজগৎ আর বিভীষিকার জগতের সঙ্গে সব ঝগড়া খতম। মেয়েরা লাল গাউন পরে ইতিউতি ঘুরছেন, উচ্ছ্বসিত হাসিতে ফেটে পড়ছেন। পুরুষেরা মেয়েদের আশপাশে, সঙ্গে সঙ্গে ছটফটিয়ে বেড়াচ্ছেন। দেওয়ালে পড়েছে আশ্চর্য সব ছায়া, কিন্তু আসলে কারওর ছায়াই নয় সেগুলো। আর এদিকে-ওদিকে আছে নানা বিশাল বিশাল আয়না, সে আয়নায় মানুষ নাই।
“আমরা সবাই ভ্যাম্পায়ার। আমরা সবাই মৃত। ভূউউউউত।” হাসতে হাসতে বললেন মি. ফ্লেচার।
সাতটি ঘর, তার সাতটি আলাদা আলাদা রং। নীল, বেগুনি, সবুজ, কমলা, সাদা, ছ-নম্বরটি রানি-রং। আর সাতেরটি কুচকুচে কালো ভেলভেটে ঢাকা।
কালো ঘরে একটা আবলুশ কাঠে তৈরি ঘড়ি থেকে প্রতি ঘণ্টার ঢং ঢং শোনা যাচ্ছে। এই ঘরগুলির ভেতর দিয়ে ছোটাছুটি করছেন অতিথিরা, শেষমেশ সবাই পুরো মাতাল। রোবটদের কাল্পনিক চরিত্র আর মানুষ মিশে যাচ্ছে ক্রমশ। ম্যাড হ্যাটার আর ডরমাউজ, খোক্কশ আর দৈত্য,
কালো বেড়াল আর শ্বেত রাণী, আর তাদের পায়ের চাপে মেঝে কাঁপছে, যেন বাড়িটার হৃদ্স্পন্দন উঠে আসছে ক্রমশ। বাড়িটা জীবন্ত হচ্ছে।
“মি স্তঁদেল!”
ফিসফিস উঠল একটা। “মি স্তঁদেল! আপনার সঙ্গে আলাদা করে একটু কথা বলতে হবে।”
একটা রাক্ষস, মুখটা মৃত্যুর মুখোশে ঢাকা।
“কী হয়েছে?”
পাইকস হাত বাড়িয়ে দেখালেন, “এই দেখুন।” একটা কঙ্কালের হাত, তার ভেতরে অর্ধগলিত কিছু চাকা, নাটবল্টু দেখা যাচ্ছে।
দীর্ঘ একটা মুহূর্ত। স্তঁদেল দেখে পাইকস কে ডেকে নিলেন একপাশে। তারপর ফিসফিস করে বললেন, “কে, গ্যারেট?”
পাইকস ঘাড় নাড়লেন। “হ্যাঁ, নিজের জায়গায় একটা রোবটকে পাঠিয়েছিল। চুল্লি পরিষ্কার করতে গিয়ে পেলাম।… তার মানে পুলিশ যে কোন মুহূর্তে এসে পড়বে। আমার পরিকল্পনা খতম।”
পাইকস বললেন।
“সেটা এখনই বলা যায় কি?” হলুদ নীল কমলা রং মানুষের নাচনকোঁদনের দিকে তাকিয়ে স্তঁদেল বললেন।
কুয়াশাভরা হলঘরে তখন গান ভেসে যাচ্ছে।
“আমার আন্দাজ করা উচিত ছিল, গ্যারেট এতটা বোকা হবে না যে নিজে আসবে। কিন্তু… দাঁড়াও দাঁড়াও…”
“কী?”
“কিচ্ছু না। কিচ্ছু অসুবিধে নেই। গ্যারেট রোবট পাঠাল, আমরাও রোবটই তো ফেরত পাঠালাম। ও তফাতটা বুঝতে পারলে তবে তো? খুব খুঁটিয়ে দেখলে তবে তো বুঝবে, তা-ই না?”
“হ্যাঁ তাও তো বটে!”
“এবার এলে ও নিজে আসবে, দেখে নিও। ও ভাববে এবার ও নিরাপদ। হয়তো এসে গেছেও দরজার সামনে। আরও মদ ঢালতে থাক, পাইকস।”
দরজার ঘন্টি বাজল জোরে।
“ওই তো এসে গেছে গ্যারেট। বাজি রেখে বলতে পারি। যাও যাও নিয়ে এসো ওকে।”
রাপুনজেলের চুল নেমে এল।
“মি স্তঁদেল?”
“মি. গ্যারেট? মানে, আসল মি. গ্যারেট।”
“হ্যাঁ, একদম।” গ্যারেট সোঁদা দেওয়াল উৎফুল্ল মানুষজন সব দেখলেন মন দিয়ে। “ভাবলাম নিজেই এসে দেখে যাই ব্যাপারখানা কী। সর্বদা কি আর রোবটদের ওপর নির্ভর করা চলে। বিশেষত অন্য লোকের রোবট? আমি সাবধানতাবশত ধ্বংসবিশারদদেরও ডেকে রেখেছি। এখুনি, ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ওরাও এসে পড়বে, আপনার এই বিদঘুটে প্রকল্পের গুষ্টির তুষ্টি করতে।”
“ভাগ্যিস বললেন। তা, এর মধ্যে আপনি সামান্য সুরাপান করুন-না কেন! একটু উপভোগ করে নিতে আপত্তি আছে নাকি।”
“না না, একেবারেই না। কী করে বলেন এমন কথা। কতটা নীচে নামতে পারে মানুষ!”
“গ্যারেট সায়েব, সেটা একবার ভালো করে দেখে নিন!”
“আপনার সব খুনে পরিকল্পনা!”
“হ্যাঁ, অতি কুৎসিত খুন।” স্তঁদেল বললেন মাথা ঝুঁকিয়ে।
এক মহিলা চিৎকার করে উঠলেন। মিস পোপ দৌড়ে এলেন। মুখটা ফ্যাকাশে। “ভয়ংকর ব্যাপার ঘটল এখুনি, দেখলাম মিস ব্লান্টকে একটা বনমানুষ গলা টিপে মেরে ফেলে একটা চিমনির ভেতর ঠুশে দিল।”
সত্যিই দীর্ঘ সোনালি চুল দেখতে পাওয়া গেল চিমনির তলা দিয়ে। গ্যারেট চেঁচিয়ে উঠলেন।
“ভয়ংকর!” মিস পোপ ফোঁপালেন।
তারপর চোখ কচলে স্তম্ভিত হয়ে দেখলেন ঘুরে। “আরে, মিস ব্লান্ট!”
“হ্যাঁ, আমিই।” মিস ব্লান্ট বললেন। সামনেই তিনি দাঁড়ান।
“কিন্তু আমি যে আপনার শরীরটাকে চিমনির ভেতরে ঠুশে ঢুকিয়ে দিতে দেখলাম।”
“না না ওটা তো আমার রোবট ছিল। খুব বুদ্ধি করে বানানো একটা কপি।”
“কিন্তু… কিন্তু…”
“আরে কাঁদে না সোনা। আমি তো ঠিকই আছি। দেখি দেখি কোথায় আমাকে দেখলে? ও ওই তো! আমি চিমনির ভেতরে… হা হা হা। সত্যি তো ঠিকই বলেছ। কী মজার, না?”
মিস ব্লান্ট হাসতে হাসতে চলে গেলেন।
“গ্যারেট একটা ড্রিংক চলবে?”
“হ্যাঁ দিন দেখি। আমার মাথাটা কেমন করছে। উফ ভগবান! কী জায়গাই না বানিয়েছেন আপনি। এ তো ধ্বংস করে ফেলতেই হবে। এক মুহূর্তের জন্য ভেবেই ফেলেছিলাম…”
গ্যারেট পানীয়ের গেলাসে চুমুক দিলেন।
আরেকটা চিৎকার। মি. স্টিফেনস, চারটে সাদা খরগোশের পিঠে চেপে একটা সিঁড়ির তলায় চলে গেলেন। গর্তে ফেলে দিয়ে এল ওকে। হাত পা বেঁধে। একটা ধারালো পেন্ডুলাম ধীরে ধীরে নেমে এল ওঁর ওপরে।
মি. স্টিফেনস গ্যারেটের পাশটিতে এসে দাঁড়িয়ে বললেন, “আরে ওটা আমি নাকি? কী কাণ্ড বলুন দিকি!!! গর্তটার ওপরে ঝুঁকে বললেন, সত্যি কী অদ্ভুত যে লাগছে, গায়ে কাঁটা দিচ্ছে মশাই। নিজেই নিজেকে মরতে দেখা!”
পেন্ডুলামটা ধড়াম করে নামল স্টিফেনের মাথার ওপরে।
“আহা কী বাস্তববাদী!” স্টিফেন বলে ঘুরে অন্যদিকে গেলেন।
“আরেকটা পানীয়, মি. গ্যারেট?”
“দিন দেখি।”
“আর তো বেশি সময় নেই, এবার ধ্বংসবিশারদরা এল বলে।”
“ভাগ্যিস!”
তৃতীয়বার একটা চীৎকার।
“এবার আবার কী!”
“এবার আমার পালা।” মিস ড্রামন্ড বললেন, “দেখুন দেখুন।”
দ্বিতীয় মিস ড্রামন্ড, আর্তনাদ করতে করতে জ্যান্ত একটা কফিনের ভেতর চালান হয়ে কাঁচা মাটির তলায় কবরস্থ হলেন।
“ওহ, আমার মনে আছে, অনেক দিন আগের একটা নিষিদ্ধ বইতে পড়েছিলাম।” ঢোঁক গিলে বললেন নৈতিক জলবায়ুর তদন্তকারী। “এর নাম জ্যান্ত গোর দেওয়া!”
তারপর একটা একটা করে সব তাঁর মনে পড়ল।
“মাটির গর্ত, পেন্ডুলাম, বনমানুষ। চিমনি। সব আমারই পোড়ানো কোনও-না কোনও বইতেই ছিল।”
“এই যে আরেকটি পানীয় গ্যারেট সায়েব। নিন নিন গ্লাস কাঁপছে ভীষণ। সাবধানে।”
“উফ আপনার কল্পনাশক্তি ভয়াবহ কিন্তু তারিফ না করে পারছি না মশাই।”
এইভাবে আরও পাঁচ ব্যক্তির মৃত্যু প্রত্যক্ষ করলেন তাঁরা। ড্রাগনের মুখে মৃত্যু, কালো হ্রদে ডুবে মৃত্যু।
“আপনার জন্য কী পরিকল্পনা নিয়েছি, দেখবেন নাকি?” স্তঁদেল বললেন।
“নিশ্চয় নিশ্চয়।” গ্যারেট সম্মত হলেন। “কী-বা এসে যায়। এমনিতেই তো পুরো বাড়িটাকেই উড়িয়ে দেব আমরা তাই না? আপনি-না, খুউব দুষ্টু!”
“আসুন তবে এই পথে।”
নীচে চললেন তাঁরা। বেশ কিছু অলিগলি পেরোলেন।
ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে নেমে পৌঁছলেন গুমঘরে।
“এখানে আমাকে কী দেখাবেন?”
“আপনার মৃত্যু?”
“ডুপ্লিকেটের মৃত্যু? তা-ই তো?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ, আরও আছে।”
“কী আছে?”
“আমন্টিলাডো।” স্তঁদেল বল্লেন। একটা লন্ঠন জ্বালিয়ে উঁচু করে ধরে নিয়ে গেলেন। কঙ্কালগুলো কফিনের ঢাকা খুলে দাঁড়িয়ে আছে আশপাশে। গ্যারেট নাক চেপে ধরলেন, বমি আসছিল তার।
“কী সেটা?”
“কোনওদিন আমন্টিলাডোর নাম শোনেননি নাকি?”
“না তো?”
“এটা কোনদিন দেখেননি?” একটা ছোট কুঠরি, কালকুঠরি দেখালেন স্তঁদেল।
“দেখার কথা ছিল নাকি?”
স্তঁদেল নিজের পোশাকের তলা থেকে একটা কর্নিক বার করলেন।
“ওটা কী?”
“আসুন এদিকে।” স্তঁদেল বললেন।
কালকুঠরির ভেতরে ঢুকলেন ওঁরা।
অন্ধকার ঘরটাতে সবকটা শিকল স্তঁদেল বেঁধে দিলেন আধমাতাল গ্যারেটের হাত ও পায়ে।
“কী করছেনটা কী!” চীৎকার করলেন গ্যারেট। ছটফট করলেন খানিক।
“আমি শ্লেষ-এর ব্যবহার করছি, মশাই। এই যে শ্লেষ নামক বিষয়টা, এটার চর্চা অতি সূক্ষ্ম। তাই এর মধ্যে ব্যাগড়া দেবেন না দয়া করে। সেটা সভ্যতা না।”
“আপনি আমাকে শিকলে বাঁধলেন তো।”
“হ্যাঁ, বাঁধলামই তো।”
“এবার কী করবেন?”
“আপনাকে এখানে রেখে দিয়ে চলে যাব।”
“আপনি কি ঠাট্টা করছেন নাকি?”
“আজ্ঞে হ্যাঁ, দারুণ মজার একটা ঠাট্টা।”
“আমার ডুপ্লিকেটটা কই? তাকে মরে যেতে দেখব না আমি?”
“আপনার কোনও ডুপ্লিকেট নেই।”
“অন্যদের যে ছিল? সেগুলো তা হলে কী?”
“অন্যেরা সবাই মরে গেছে। যাদের মরে যেতে দেখেছেন তারা সব আসল লোক। ডুপ্লিকেটগুলো ছিল রোবট।”
গ্যারেট চুপ করে গেলেন।
“এবার আপনার বলার কথা, “ঈশ্বরের দোহাই, আমার প্রিয়তম!”
আমি উত্তরে বলব, হ্যাঁ ঈশ্বরের দোহাই। কী, বলবেন না? বলুন, বলুন।”
“তুমি মূর্খ।”
“আর কতবার অনুরোধ করব আপনাকে? বলুন, বলুন দয়া করে। “ঈশ্বরের দোহাই, আমার প্রিয়তম!”
“বলব না। হস্তিমূর্খ তুমি। আমাকে এখান থেকে বের করো।”
গ্যারেটের এবার নেশা কেটে গেছে।
“এই যে এটা পরুন।” একটা জিনিস ওকে ছুড়ে দিলেন স্তঁদেল। ঘুন্টি বাঁধা সেটা।
“এটা কী?”
“ঘুন্টিবাঁধা টুপি। এটা পরলে আপনাকে আমি ছেড়ে দিতেও পারি।”
“স্তঁদেল!”
“পরুন, পরুন ওটা। বলছি পরুন।”
গ্যারেট পরলেন। ঘুন্টিগুলো বাজল।
“আপনার মনে হচ্ছে না এই সব, সব কোনদিন, অনেক আগের একদিন ঘটে গেছে? স্তঁদেল বললেন। তারপর কর্নিক দিয়ে সিমেন্ট-মিশ্রণ তুলে নিলেন। ইট নিলেন হাতে। “
“কী করছ কী?”
“দেওয়াল তুলে বন্ধ করে দিচ্ছি কালকুঠুরি।”
“তুমি উন্মাদ!”
“এ নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই।”
“তোমাকে শাস্তি পেতে হবে।”
গুনগুন গাইতে গাইতে স্তঁদেল ঠুকে ঠুকে ইটগুলো সঠিক জায়গায় লাগিয়ে দিলেন। একটা একটা করে ইট চাপিয়ে পুরো দেওয়ালটা বন্ধ করতে লাগলেন।
এবার ঝনঝন শব্দে গ্যারেট প্রতিবাদ জানালেন। চিৎকার ভেসে আসতে লাগল একটা প্রায়ান্ধকার জায়গা থেকে। ইট উঠতে লাগল।
“আরও লাফ ঝাঁপ দিন আপনি। নাটক জমে উঠেছে।”
“আমাকে মুক্তি দাও, মুক্তি দাও।”
শেষ ইটের আগের সব কটা ইট সঠিকভাবে গুঁজে দিলেন স্তঁদেল। চিৎকার চলতে লাগল।
স্তঁদেল আলতোভাবে বললেন, “গ্যারেট?”
গ্যারেট নীরব।
“জানতে চান না, কেন আপনার সঙ্গে এটা করলাম আমি?
“কারণ আপনি না পড়েই পো সায়েবের বইগুলো পুড়িয়ে দিয়েছেন। কারণ আপনি অন্য লোকের বুদ্ধিতে চলেছেন, তাদের উপদেশ গ্রহণ করেছেন, যে এ বইগুলো পুড়িয়ে দেওয়াই দস্তুর।…
“অন্যথা, আপনি জানতেন, আপনাকে নিয়ে আমি কী করতে চলেছি। যখন এখানে এলেন তখনই বুঝতে পারতেন মি. গ্যারেট। পড়াশুনোটা তো ঠিকঠাক করেননি আপনি। আর অজ্ঞানতা থেকে তো মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতেই পারে মি. গ্যারেট।”
গ্যারেট নীরব।
“আমি চাই শেষটা নিখুঁত হোক।” লন্ঠন ওপরে তুলে ধরলেন স্তঁদেল। সামান্য আলো ঢুকল ভেতরে। “আপনার ঘুন্টিগুলো নেড়ে আমাকে জানান দিন। বলুন, “ঈশ্বরের দোহাই, আমার প্রিয়তম!” তা হলে হয়তো আমার আপনাকে মুক্তি দিতে ইচ্ছে হতেও পারে মি গ্যারেট।”
আলোতে লোকটার মুখ দেখা গেল। সামান্য দ্বিধার পর, মোটা গলায় বিশ্রিভাবে বললেন, “ঈশ্বরের দোহাই, আমার প্রিয়তম!”
“আহ!” স্তঁদেল বললেন, চোখ বুজলেন। শেষ ইটটা ছোট ফাঁকটায় ভরে দিয়ে মাটি বোজালেন।” শান্তিতে ঘুমান, আমার বন্ধু।”
কালকুঠরি থেকে সরে এলেন। গুমঘর থেকে উঠে চলে গেলেন দ্রুতপায়ে স্তঁদেল।
সাতটা ঘরের ভেতরে মধ্যরাতের ঘড়ির ঢং ঢং ঘুরপাক খাচ্ছে তখন। লাল রাক্ষস এসে দাঁড়াল।
স্তঁদেল দরজার কাছে একবার ঘুরে দাঁড়ালেন, সব দেখলেন। তারপর দৌড়ে বেরুলেন আশারদের বাড়ি থেকে, চললেন হেলিকপ্টারের কাছে, জলাটা পেরিয়ে।
“পাইকস, প্রস্তুত আমরা?”
“হ্যাঁ প্রস্তুত।”
“এই তবে শেষ।”
বিশাল বাড়িটার দিকে তাঁরা হাসিমুখে চেয়ে রইলেন।
বাড়িটা মাঝবরাবর চিড় খেতে লাগল…। যেমন ভূমিকম্পে হয়। স্তঁদেল সেই অভূতপূর্ব সুন্দর দৃশ্য দেখতে লাগলেন। পাইকস পেছন থেকে বই থেকে পড়তে লাগলেন নীচু, ছন্দোময় গলায়—
“আমার মাথা ঘুরছিল। আমি দেখলাম বিশাল দেওয়ালগুলো দ্রুত হেলে পড়ছে, ফেটে যাচ্ছে। দীর্ঘ এক হাড়কাঁপানো চীৎকারের মতো, সহস্র ঝর্নার ধ্বনির কণ্ঠে যেন, একটা আওয়াজ উঠল। আর আমার পায়ের কাছে গভীর আর শীতল হ্রদটা ক্রমে বুজে গেল নীরবে, যেন অভিমান ভরেই। আশারদের বাড়ির একটা ভাঙা পাথরও আর অবশিষ্ট রইল না।”
হেলিকপ্টারটা জলাটার ঢেউয়ের ওপর দিয়ে বাতাস কেটে পশ্চিমের দিকে উড়ে গেল।
মূল গল্প: আশার ২
মূল লেখক: রে ব্র্যাডবেরি
দারুণ হয়েছে